হরিবংশ রায় বচ্চন: জীবন, সাহিত্য ও অমূল্য অবদান

হরিবংশ রায় বচ্চন: জীবন, সাহিত্য ও অমূল্য অবদান
সর্বশেষ আপডেট: 18-01-2025

হরিবংশ রায় বচ্চন: ১৮ জানুয়ারি হরিবংশ রায় বচ্চনের পুণ্যতিথি। এই দিনেই তিনি মুম্বাইতে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। ২৭ নভেম্বর ১৯০৭ সালে প্রয়াগ (বর্তমানে ইলাহাবাদ) এ জন্মগ্রহণকারী হরিবংশ রায় বচ্চন ছিলেন হিন্দি সাহিত্যের একজন মহান কবি ও লেখক। তিনি ছিলেন হিন্দি কবিতার ছায়াবাদী কাব্যধারার পরবর্তী কবিদের একজন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যরচনা 'মধুশালা', যা আজও হিন্দি সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার জীবন কেবল কাব্যরচনাই নয়, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি তার অবদানও অনুপ্রেরণার উৎস।

শিক্ষা ও প্রাথমিক কর্মজীবন

হরিবংশ রায় বচ্চনের শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজিতে এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। তার পিএইচ.ডি. থিসিসের বিষয় ছিল ডব্লিউ. বি. ইয়েটসের কবিতা। এরপর কিছুকাল ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং পরে ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ে হিন্দি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।

বিবাহ ও পারিবারিক জীবন

১৯২৬ সালে বচ্চন মহাশয়ের বিবাহ হয় শ্যামা বচ্চনের সাথে, যিনি তখন মাত্র ১৪ বছর বয়সী ছিলেন। তবে ১৯৩৬ সালে ক্ষয় রোগে শ্যামার মৃত্যু হয়। এরপর ১৯৪১ সালে তিনি তেজি সূরির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি ছিলেন রঙ্গমঞ্চ ও গানের সাথে যুক্ত। এই বিবাহের পর তিনি 'নিড়ের নির্মাণ ফির' এর মতো অনুপ্রেরণাদায়ক কবিতা রচনা করেন। তার পুত্র অমিতাভ বচ্চন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের একজন মহান অভিনেতা, যার নাম আজ পুরো বিশ্বে পরিচিত।

সাহিত্যিক অবদান ও বিখ্যাত রচনা

•    মধুশালা (১৯৩৫)
•    আত্ম পরিচয় (১৯৩৭)
 •    নিশা নিমন্ত্রণ (১৯৩৮)
•    একাঙ্গী সংগীত (১৯৩৯)
•    মিলন যামিনী (১৯৫০)
•    প্রণয়পত্রিকা (১৯৫৫)
•    দুই চট্টান (১৯৬৫)
•    নিড়ের নির্মাণ ফির (১৯৭০)
•    কি ভুলব কি মনে রাখব (১৯৬৯)
এছাড়াও তিনি 'প্রবাসীর ডায়েরি', 'আজকের লোকপ্রিয় হিন্দি কবি', 'পন্তের শত পত্র' ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার সাহিত্য জগতে বিশেষ স্থান রয়েছে।

সম্মান ও পুরস্কার

হরিবংশ রায় বচ্চন তার সাহিত্যিক অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬৮ সালে 'দুই চট্টান' কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার এবং আফ্রো-এশীয় সম্মেলনের কমল পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৬ সালে সাহিত্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণে ভূষিত করেন।
২০০২ সালের শীতকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভোগেন। ১৮ জানুয়ারি ২০০৩ সালে মুম্বাইতে তার মৃত্যু হয়, যা ভারতীয় সাহিত্য জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।

কাব্যশৈলী ও প্রভাব

হরিবংশ রায় বচ্চনের কবিতাগুলি সাধারণ মানুষের সাথে জড়িত ছিল। তিনি তার কবিতায় জীবনের সকল দিক—প্রেম, হতাশা, সংগ্রাম ও আশা—প্রকাশ করেছেন। তার কাব্যশৈলীতে গভীর সংবেদনশীলতা ও মানবতার ছাপ স্পষ্ট। তার রচিত 'মধুশালা' এর মতো কাব্যগ্রন্থগুলি কেবল সাহিত্যিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এগুলি হিন্দি কবিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তার অবদান হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সমাজ ও সাহিত্যে অবদান

বচ্চন মহাশয়ের অবদান কেবল সাহিত্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ভারতীয় সমাজে শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তার সময়ের সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তার কবিতায় তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করে তুলেছেন। তার জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

হরিবংশ রায় বচ্চনের জীবন ও সাহিত্যিক অবদান আজও ভারতীয় সাহিত্য ও সমাজের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তার কাব্যরচনাগুলি কেবল সাহিত্যের জগতকে সমৃদ্ধই করেনি, ভারতীয় সমাজকেও সচেতন করে তুলেছে। তার নাম সর্বদা হিন্দি সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে এবং তার কবিতাগুলি আগামী প্রজন্মের জন্য मार्गदर्शनের কাজ করবে।

Leave a comment