ভারতে চিকিৎসা ও সিভিল সার্ভিস, দুই ক্ষেত্রেই কর্মজীবন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি এই দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করেন, তখন তা কেবল সাফল্য নয়—এটি একটি অনুকরণীয় উদাহরণে পরিণত হয়। আজ আমরা আলোচনা করছি ডাঃ অঞ্জলি গর্গ সম্পর্কে, যিনি প্রথমে চিকিৎসক হয়েছেন এবং পরে আইএএস কর্মকর্তাও হয়েছেন। তাঁর গল্প পরিশ্রম, সংগ্রাম ও অদম্য স্পৃহার একটি চমৎকার উদাহরণ।
চণ্ডীগড় থেকে শুরু: শৈশব থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন
ডাঃ অঞ্জলি গর্গের জন্ম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে চণ্ডীগড় শহরে। তাঁর পরিবার ব্যবসা-সংক্রান্ত ছিল, কিন্তু অঞ্জলি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন এবং তাঁর স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়া। তিনি কম বয়স থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবেন। তাঁর পরিবারে সিভিল সার্ভিস বা চিকিৎসা ক্ষেত্রের কোনো পটভূমি ছিল না, তবুও তিনি নিজের পরিশ্রম ও নিষ্ঠার বলে পথ তৈরি করেছেন।
অঞ্জলির স্কুলিং চণ্ডীগড়ে হয়েছিল এবং তিনি প্রতিটি ক্লাসে চমৎকার ফলাফল অর্জন করেছিলেন। যখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে পৌঁছান, তখন তিনি বিজ্ঞান বিষয় নির্বাচন করেন এবং প্রচুর পরিশ্রম করেন। এই পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে তিনি বোর্ড পরীক্ষায় ৯৬% নম্বর পান, যা একটি বড় সাফল্য ছিল। এর পরে তিনি NEET পরীক্ষা দেন, যা MBBS-এ ভর্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। তিনি প্রথম প্রয়াসেই NEET পাস করেন এবং দিল্লির বিখ্যাত বর্ধমান মহাবীর মেডিকেল কলেজ (VMMC) এবং সফদরজং হাসপাতালে MBBS পড়াশোনা শুরু করেন। এখান থেকেই তাঁর স্বপ্নের আসল যাত্রা শুরু হয়।
MBBS-এর সময় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, UPSC-এর দিকে ঝোঁক
MBBS-এর তৃতীয় বর্ষে যখন অঞ্জলি হাসপাতালে রোগীদের অবস্থা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে কেবল চিকিৎসক হয়ে তিনি সমাজে বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে পারবেন না। তিনি বুঝতে পারেন যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উন্নতি আনার জন্য কেবল চিকিৎসাই নয়, নীতিগত পর্যায়েও কাজ করা প্রয়োজন। হাসপাতালে প্রতিদিন তিনি যা দেখেন, তাতে তিনি প্রভাবিত হন এবং বুঝতে পারেন যে যদি তিনি সিভিল সার্ভিসে যান, তাহলে স্বাস্থ্য সেবা উন্নত করতে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবেন।
এই চিন্তাভাবনার সাথে অঞ্জলি UPSC-এর প্রস্তুতি শুরু করেন। তবে, চিকিৎসা পটভূমি থাকার কারণে সিভিল সার্ভিসের সিলেবাস এবং এর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে তাঁকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। তবুও, তাঁর দৃঢ় সংকল্প এবং সংগ্রাম তাঁকে এই নতুন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।
সহজ ছিল না পথ, প্রথমবার ব্যর্থতা
অঞ্জলির জন্য UPSC-এর প্রস্তুতি একেবারেই সহজ ছিল না। তিনি চিকিৎসা ক্ষেত্র থেকে আসা, তাই সিভিল সার্ভিসের সিলেবাস এবং এর প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁর আগে থেকে কোনো বিশেষ ধারণা ছিল না। তাছাড়া, যখন তিনি করোনা মহামারীর সময় তাঁর প্রথম প্রয়াস করেছিলেন, তখন তিনি ব্যর্থ হন। তবে, এই ব্যর্থতা তাঁকে হতাশ করেনি। তিনি এটিকে একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে নিয়েছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর প্রস্তুতি উন্নত করবেন। অঞ্জলি তাঁর ভুল থেকে শিখেছিলেন এবং পরবর্তী প্রয়াসে তাঁর প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করেছিলেন। यही ছিল তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি—কখনো হতাশ না হওয়া এবং প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
দ্বিতীয় প্রয়াসে সাফল্য, আইএএস কর্মকর্তা হলেন
অঞ্জলি ২০২২ সালে UPSC পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার প্রয়াস করেছিলেন এবং এবার তিনি অল ইন্ডিয়া র্যাঙ্ক ৭৯ পেয়েছেন। এই সাফল্যের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন যে কখনো হার মানা উচিত নয়। প্রথম প্রয়াসে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও, অঞ্জলি তাঁর কৌশলে পরিবর্তন আনেন এবং তাঁর প্রস্তুতি আরও শক্তিশালী করেন। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানকে তাঁর ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন এবং এতে চমৎকার পারফর্মেন্স করেন, যার ফলে তিনি পরীক্ষায় টপ করতে সক্ষম হন। তাঁর কঠোর পরিশ্রম এবং নিবেদিততা তাঁকে এই সাফল্য এনে দিয়েছে। এই গল্প আমাদের শেখায় যে, যদি আমরা আমাদের লক্ষ্যের প্রতি সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত থাকি, তাহলে কোনো বাধাই আমাদের পথে আসতে পারবে না।
একসাথে চলত ডিউটি, কোচিং এবং পড়াশোনা
অঞ্জলি গর্গের দিনচর্যা ছিল অত্যন্ত কঠিন। হাসপাতালে ১২ ঘন্টার রাতের ডিউটির পর তিনি ঘুম না ঘুমিয়ে সরাসরি কোচিং ক্লাসে যেতেন এবং তারপর তাঁর পড়াশোনায় মনোযোগ দিতেন। ঘুমের অভাব, শারীরিক ক্লান্তি এবং অসুস্থতার পরও তিনি কখনো তাঁর লক্ষ্যকে উপেক্ষা করেননি। এটি তাঁর দৃঢ় সংকল্প ও নিবেদিততার ফল যে তিনি UPSC-এর মতো কঠিন পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করেছেন। অঞ্জলির এই সংগ্রাম এটার উদাহরণ যে, ইচ্ছাশক্তি যদি দৃঢ় হয়, তাহলে কোনো কঠিন পরিস্থিতিই অতিক্রম করা সম্ভব।
আজ আইএএস অঞ্জলি গর্গ সেই যুবকদের জন্য একজন রোল মডেল, যারা একসাথে অনেক দায়িত্ব পালন করে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে চান। তাঁর গল্প শেখায় যে, সময়ের অভাব, ক্লান্তি বা ব্যর্থতাও যদি জয়ের ইচ্ছার সামনে টিকতে না পারে।