একটি বিরাট সাফল্যের মুখ দেখল ভারতের রেলওয়ে খাত। খুব শীঘ্রই ভারতে তৈরি স্বদেশী ট্রেন ইঞ্জিন আফ্রিকার দেশ গিনি-র রেলপথে ছুটতে দেখা যাবে।
নয়াদিল্লি: আত্মনির্ভর ভারতের ধারণা এখন আর কেবলমাত্র দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারত এখন বিশ্ববাসীর কাছে তার প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও শিল্প ক্ষমতার পতাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। এই দিকে একটি বিরাট সাফল্যের মুখ দেখা গেল যখন ভারতীয় রেল মন্ত্রণালয় ঘোষণা করল যে, ভারত আফ্রিকার দেশ গিনিকে ১৫০টি লোকোমোটিভ সরবরাহ করবে। এই পদক্ষেপ ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের জন্য একটি মাইলফলক এবং এটি প্রমাণ করে যে ভারত বিশ্বব্যাপী রেলওয়ে সরঞ্জাম উৎপাদন ও রপ্তানির একটি বৃহৎ কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
মরহৌরা থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত: লোকোমোটিভের নতুন যাত্রা
বিহারের সারণ জেলার মরহৌরায় অবস্থিত রেলওয়ে লোকোমোটিভ কারখানাকে কেন্দ্র করে আজ দেশ গর্বিত বোধ করছে। এখানেই এই ১৫০টি লোকোমোটিভ তৈরি করা হবে, যা আগামী তিন বছরের মধ্যে গিনিকে হস্তান্তর করা হবে। এই চুক্তির মোট মূল্য ৩০০০ কোটি টাকার বেশি, যা ভারত একটি বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক নিবিদা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করেছে।
রেলওয়ে বোর্ডের তথ্য ও প্রচার বিভাগের নির্বাহী পরিচালক দিলীপ কুমারের মতে, চলতি অর্থবছরে ৩৭টি ইঞ্জিন গিনিতে পাঠানো হবে। পরবর্তী অর্থবছরে ৮২টি ইঞ্জিন এবং শেষ বছরে বাকি ৩১টি ইঞ্জিন গিনিকে হস্তান্তর করা হবে। এই পুরো পরিকল্পনা ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে।
উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ভারতীয় ইঞ্জিন
এই সমস্ত লোকোমোটিভ আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ হবে এবং এতে এয়ার কন্ডিশনিংয়ের সুবিধাও থাকবে। দুটি ইঞ্জিন একত্রে সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য গতিতে ১০০টি বগির ভারী মালগাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখবে। এই লোকোমোটিভে ডিস্ট্রিবিউটেড পাওয়ার ওয়্যারলেস কন্ট্রোল সিস্টেম বা DPWCSও ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে সিঙ্ক্রোনাইজ অপারেশনের সুবিধা পাওয়া যাবে এবং মাল পরিবহন আরও দক্ষ হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, মরহৌরা কারখানার চত্বরে তিন ধরণের রেললাইন- ব্রড গেজ, স্ট্যান্ডার্ড গেজ এবং কেপ গেজ স্থাপন করা হয়েছে, যাতে বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী ইঞ্জিন তৈরি করা যায়। এতে করে এই কারখানা বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়ে উঠেছে।
গিনির উন্নয়ন যাত্রায় ভারতের অবদান
এই লোকোমোটিভ সরবরাহ কেবলমাত্র একটি ব্যবসায়িক চুক্তি নয়, বরং এটি ভারত ও গিনির মধ্যে বর্ধমান কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রতীক। রেল মন্ত্রণালয়ের মতে, এই ইঞ্জিন গিনির বৃহত্তম লৌহ আকরিক প্রকল্পের মূল ভিত্তিমূলকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এতে কেবলমাত্র গিনির অর্থনীতিই গতি পাবে না, বরং ভারতের প্রযুক্তিগত ও শিল্পের শ্রেষ্ঠত্বেরও প্রচার-প্রসার হবে।
স্থানীয় কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় জোর
এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সামাজিক সুফল হলো এটি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে। দিলীপ কুমার জানিয়েছেন যে, বর্তমানে মরহৌরা কারখানায় ২৮৫ জন সরাসরি কাজ করছেন, অন্যদিকে ১২১৫ জন পরোক্ষভাবে এর সাথে যুক্ত। এছাড়াও, দেশজুড়ে ২১০০ জনের বেশি লোক এই যৌথ উদ্যোগের জন্য বিভিন্ন সেবা ও প্রকল্পে কাজ করছেন।
এতে ভারতে কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত দক্ষতা উৎসাহিত হবে না, বরং রেলওয়ে শিল্পের সাথে যুক্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পও ব্যাপক উপকৃত হবে। এতে আত্মনির্ভর ভারত অভিযান শক্তিশালী হবে এবং দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাবে।
বিশ্বব্যাপী রপ্তানি কেন্দ্র হিসেবে মরহৌরা
মরহৌরার এই কারখানা এখন কেবলমাত্র একটি রেলওয়ে ইঞ্জিন নির্মাণ কেন্দ্র নয়, বরং এটি ভারতের বিশ্বব্যাপী শিল্প ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এটি প্রথমবার নয় যখন ভারত বিদেশে রেলওয়ে সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে, তবে এটি এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এবং প্রযুক্তিগতভাবে পরিশীলিত রপ্তানি চুক্তি। এতে ভারত একটি নির্ভরযোগ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নতুন পরিচয় পাবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব
এই চুক্তি অর্জনের জন্য ভারত অন্যান্য অনেক দেশের কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করেছে এবং প্রযুক্তি, মূল্য এবং সময়সীমা অনুযায়ী জয়ী হয়েছে। এটি ইঙ্গিত করে যে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিগুলি এখন বিশ্বমানের মানের এবং সেবা প্রদান করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।
ভারত সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির এটি একটি সফল উদাহরণ, যেখানে স্বদেশী উৎপাদনের মাধ্যমে কেবলমাত্র দেশীয় চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিক চাহিদাও আত্মবিশ্বাসের সাথে মোকাবেলা করা হচ্ছে।
ভারত-আফ্রিকা সম্পর্কের নতুন উচ্চতা
ভারত ও আফ্রিকার দেশগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে এই সহযোগিতা আরও শক্তিশালী হবে। ভারত আফ্রিকাকে কেবলমাত্র একটি বাজার হিসেবে নয়, বরং একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে। গিনিকে লোকোমোটিভ সরবরাহ করার ফলে কেবলমাত্র ব্যবসা বৃদ্ধি পাবে না, বরং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও শক্তিশালী হবে।