গাছের উপর উল্টো করে ঝুলে থাকা বেতালকে রাজা বিক্রমাদিত্য আবার গাছে উঠে নামালেন এবং নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। বেতাল মনে মনে রাজার ধৈর্য ও সাহসের প্রশংসা করছিল। বেতাল আবার গল্প শুরু করল। এক সময় বারাণসীতে রাজা মহেন্দ্রের রাজত্ব ছিল। তিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের মতোই দয়ালু এবং ধৈর্যশীল ছিলেন। নৈতিকতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর এই গুণগুলির কারণে প্রজারা তাঁকে খুব ভালোবাসত। সেই শহরে ধন মাল্য নামে এক খুব ধনী ব্যবসায়ী বাস করত। তিনি তাঁর ব্যবসা এবং ধন-সম্পদের জন্য দূর-দূরান্তে বিখ্যাত ছিলেন। ধনমাল্যের এক সুন্দরী যুবতী কন্যা ছিল।
লোকে বলত যে সে এত সুন্দরী ছিল যে স্বর্গের অপ্সরারাও তাকে ঈর্ষা করত। তার কালো লম্বা চুল দেখে মনে হত যেন কালো মেঘ, ত্বক ছিল দুধের মতো সাদা এবং স্বভাব ছিল বনের হরিণের মতো কোমল। রাজা তার রূপের প্রশংসা শুনে তাকে পাওয়ার ইচ্ছা রাজার মনে জেগে ওঠে। রাজা তাঁর দুই বিশ্বস্ত সেবিকাকে ডেকে বললেন, “তোমরা গিয়ে ব্যবসায়ীর বাড়িতে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করো। লোকেরা যা বলছে তার সত্যতা যাচাই করো যে, সে সত্যিই রানি হওয়ার যোগ্য কিনা।” সেবিকারা তাদের কাজের জন্য রওনা দিল।
ছদ্মবেশ ধারণ করে তারা ব্যবসায়ীর বাড়িতে পৌঁছল। ব্যবসায়ীর মেয়ের সৌন্দর্য দেখে তারা অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল। প্রথম সেবিকা বলল, “ওহ! কী রূপ! রাজার অবশ্যই একে বিয়ে করা উচিত।” দ্বিতীয় সেবিকা বলল, “তুমি ঠিক বলছ। এমন রূপ আমি আগে কখনো দেখিনি। রাজা তো এর থেকে চোখ সরাতে পারবেন না।” কিছুক্ষণ দুজনে চিন্তা করল, তারপর দ্বিতীয় জন বলল, “তোমার কি মনে হয় না, যদি রাজা বিয়ে করেন তাহলে তার মন কাজ থেকে সরে যাবে?” প্রথম জন মাথা নেড়ে রাজি হয়ে বলল, “তুমি ঠিক বলছ। যদি এমন হয়, তাহলে রাজা তাঁর রাজ্য এবং প্রজার দিকে মনোযোগ দিতে পারবেন না।” দুজনেই রাজাকে সত্যি কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিল।
রাজা তাদের উপর খুব ভরসা করতেন। তারা যা বলেছিল, রাজা সেটাকেই সত্যি বলে মেনে নিলেন। কিন্তু তাঁর মন ভেঙে গেল। একদিন ধনমাল্য নিজেই তাঁর মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে রাজার কাছে এলেন, কিন্তু দুঃখিত রাজা কোনো চিন্তা না করেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। হতাশ হয়ে ধনমাল্য তাঁর মেয়ের বিয়ে রাজার এক সভাসদের সঙ্গে দিয়ে দিলেন। জীবন তার নিজের ছন্দে চলছিল। কয়েক দিন কেটে গেল। একদিন রাজা তাঁর রথে চড়ে তাঁর সভাসদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জানালাতে এক সুন্দরী মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। রাজা তার রূপে মুগ্ধ হলেন। রাজা সারথিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি এমন রূপ আগে কখনো দেখিনি। এই জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি কে?”
সারথি বলল, “মহারাজ, ইনি হলেন ব্যবসায়ী ধনমাল্যের একমাত্র কন্যা। লোকেরা বলে যে স্বর্গের অপ্সরারাও তাঁর রূপ দেখে ঈর্ষা করে। আপনারই এক সভাসদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে।” রাজা রেগে গিয়ে বললেন, “যদি তোমার কথা সত্যি হয়, তাহলে দুই সেবিকা আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছে। এখনই তাদের আমার কাছে নিয়ে আসা হোক। আমি তাদের মৃত্যুদণ্ড দেব।” দুই সেবিকাকে রাজার সামনে আনা হল। আসামাত্রই তারা রাজার পা ধরে ক্ষমা চাইতে লাগল এবং তারা রাজাকে সব কথা খুলে বলল। কিন্তু রাজা তাদের কথায় মনোযোগ না দিয়ে তাদের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। গল্প শেষ করে বেতাল বলল, “প্রিয় রাজন! দুই সেবিকাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রাজা মহেন্দ্রের সিদ্ধান্ত কি আপনার কাছে সঠিক মনে হয়?”
বিক্রমাদিত্য জবাব দিলেন, “একজন সেবকের কর্তব্য হল তার প্রভুর আদেশ মেনে চলা। সেবিকারা শাস্তির যোগ্য ছিল। তাদের রাজাকে যা দেখেছিল তাই বলা উচিত ছিল, কিন্তু তারা তা করেনি। তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। তারা রাজা ও রাজ্যের ভালোর কথাই ভেবেছিল। তাদের কাজ নিঃস্বার্থ ছিল। এই পরিস্থিতিতে রাজাকে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত হয়নি।” “বাহাদুর রাজা, তুমি সঠিক উত্তর দিয়েছ।” এই কথা বলতে বলতে বেতাল বাতাসে উড়ে আবার গাছে গিয়ে বসল।