এক মাস আগে কেরালের মালপুরম জেলার এক ৬ বছরের শিশু আবাল কুকুরের আক্রমণে আহত হয়েছিল। তবে, তাকে র্যাবিজের টিকা দেওয়া হয়েছিল, তারপরও মঙ্গলবার র্যাবিজে তার মৃত্যু হয়।
কেরাল: মালপুরম জেলা থেকে আসা একটি মর্মান্তিক ঘটনা সকলকে নাড়া দিয়েছে। এখানে এক ৬ বছরের শিশুর কুকুরের কামড়ে র্যাবিজে মৃত্যু হয়েছে, যদিও তাকে সময়মতো টিকা দেওয়া হয়েছিল। এই খবরটি অনেক প্রশ্ন তুলে ধরেছে—টিকা দেওয়ার পরেও কি র্যাবিজে মৃত্যু হতে পারে? চিকিৎসায় কোথায় ত্রুটি হয়েছিল? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কুকুরের কামড়ের পরে তাৎক্ষণিকভাবে কী করা উচিত?
ছোট্ট শিশুটির সাথে কী ঘটেছিল?
এই মর্মান্তিক ঘটনা কেরালের মালপুরম জেলার পেরুভাল্লুর গ্রামের। এখানে ৬ বছরের এক ছোট্ট শিশু, যার নাম জিয়া ফারিস, তার বাড়ির কাছের এক দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে গিয়েছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ একটা আবাল কুকুর তার উপর আক্রমণ করে। কুকুরটি শিশুটিকে মাথায়, মুখে এবং পায়ে ভয়াবহভাবে কামড়ায়, ফলে তীব্র আঘাত পায়।
কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কায় পরিজনরা তাকে অবিলম্বে কোঝিকোডের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা র্যাবিজের টিকা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ দেন। চিকিৎসার পর শিশুটির অবস্থা কিছুটা ভালো হলে তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক দিন পর তার শারীরিক অবস্থা আবার খারাপ হতে শুরু করে। তাকে তীব্র জ্বর হয় এবং সে ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময়ই পরিজনরা বুঝতে পারে যে শিশুটি র্যাবিজে আক্রান্ত হয়েছে।
পুনরায় পরীক্ষায় ধরা পড়ে র্যাবিজ
যখন শিশুটির জ্বর হয়, তখন পরিবার তাকে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। এবারের পরীক্ষায় জানা যায় যে সে র্যাবিজে আক্রান্ত। এই কথা শুনে পরিবারের সকলেই হতবাক হয়ে যায়, কারণ শিশুটিকে আগেই র্যাবিজের টিকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর তাকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে রাখেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে, কুকুরের কামড়ে মাথায় যে গভীর আঘাত হয়েছিল, সেখান থেকে ভাইরাস সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছে গিয়ে থাকতে পারে। মাথার আঘাতটি ছিল বেশ গুরুতর, যার ফলে র্যাবিজের ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং টিকার প্রভাব কমে যায়। চিকিৎসা সত্ত্বেও শিশুটির অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে থাকে। অন্ততঃ ২৩শে এপ্রিল শিশুটি মারা যায়।
এই ঘটনা বলে দেয় যে, কুকুরের কামড়ের পরে কেবলমাত্র টিকা দেওয়া যথেষ্ট নয়, গভীর ক্ষতের সঠিক যত্ন এবং নিয়মিত পরীক্ষাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসকরা কী বলেছেন?
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে শিশুটিকে সময়মতো র্যাবিজের টিকা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সমস্যা হলো, কুকুরটি তাকে মাথা এবং মুখের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল স্থানে কামড়েছিল। চিকিৎসকদের মতে, যখন আঘাত এমন জায়গায় হয় যেখান থেকে মস্তিষ্কের পথ খুব কাছে, তখন সংক্রমণ খুব দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কখনও কখনও টিকাও পুরোপুরি কার্যকর হয় না। এটাই কারণ শিশুটি সময়মতো চিকিৎসা ও টিকা পেলেও তার প্রাণ রক্ষা করা যায়নি। চিকিৎসকরা আরও বলেছেন যে, এই ধরণের ঘটনায় কেবলমাত্র টিকা দেওয়া যথেষ্ট নয়, বরং ক্ষতের সঠিক যত্ন এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কুকুরের কামড়ে কী করা উচিত?
কুকুরের কামড় একটি সাধারণ ঘটনা, কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনা কখনও কখনও প্রাণঘাতীও হতে পারে। সম্প্রতি কেরালে ৬ বছরের শিশুটির মৃত্যু এর এক দুঃখজনক উদাহরণ। সময়মতো র্যাবিজের টিকা দেওয়া সত্ত্বেও তার প্রাণ রক্ষা করা যায়নি কারণ ক্ষতটি মাথার মতো নাজুক স্থানে ছিল, যার ফলে সংক্রমণ দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই, এই ধরনের ঘটনাকে হালকাভাবে নেওয়া বিপদজনক হতে পারে।
- ক্ষত স্থান অবিলম্বে পরিষ্কার করুন: প্রথমে যেখানে কুকুরটি কামড়েছে সেখানে অবিলম্বে পরিষ্কার করুন। এটিকে প্রবাহিত জল এবং সাবান দিয়ে অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধুতে হবে। এটি করার ফলে সেখানে উপস্থিত ভাইরাসের সংখ্যা কমে যায় এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমে যায়।
- অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যান: কুকুরের কামড়ের পর কোনো ধরণের ঘরোয়া চিকিৎসা করবেন না। সরাসরি ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখবেন ক্ষতটি কতটা গভীর এবং কোন স্থানে, তার অনুযায়ী তিনি র্যাবিজের টিকা বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন।
- টিকার পুরো ডোজ অবশ্যই নিন: র্যাবিজ থেকে রক্ষা পেতে কেবলমাত্র একটি ইনজেকশন যথেষ্ট নয়। এর একটি নির্দিষ্ট ডোজ থাকে, যা সময়মতো নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। যদি মাঝখানে কোনো ডোজ মিস হয়, তাহলে টিকা পুরোপুরি কার্যকর হয় না এবং রোগের ঝুঁকি থেকে যায়।
- যদি ক্ষত গুরুতর হয়, তাহলে RIG নিন: যদি কুকুরটি মাথা, মুখ বা ঘাড়ের মতো সংবেদনশীল স্থানে কামড়ায়, তাহলে ডাক্তার ‘র্যাবিজ ইমিউনোগ্লোবুলিন (RIG)’ নামক একটি বিশেষ ওষুধও দিতে পারেন। এটি শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধ করে এবং দ্রুত কার্যকর হয়।
- শরীরের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করান: বিশেষ করে যখন কোনো শিশুকে কুকুর কামড়ায়, তখন তাদের শরীরের সম্পূর্ণ পরীক্ষা করান। কখনও কখনও ক্ষত এমন জায়গায় হয় যা আমাদের প্রথম নজরে দেখা যায় না, যার ফলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকে।
- লক্ষণগুলির উপর নজর রাখুন: যদি টিকা দেওয়ার পরেও জ্বর, বিভ্রান্তি, মাথাব্যথা বা দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে তা উপেক্ষা করবেন না। অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন, কারণ এগুলি র্যাবিজের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
র্যাবিজ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি
র্যাবিজ একটি ভয়াবহ রোগ যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুকুরের কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। যখন কোনো সংক্রামিত কুকুর কোনো মানুষকে কামড়ায়, তখন তার লালায় থাকা ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে। এই ভাইরাস সরাসরি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। যদি সময়মতো চিকিৎসা না হয়, তাহলে এই রোগ প্রাণঘাতী হতে পারে।
র্যাবিজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এর লক্ষণগুলি যদি একবার শরীরে দেখা দিতে শুরু করে, তাহলে এর চিকিৎসা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কুকুর কামড়ানোর সাথে সাথেই তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। ক্ষত স্থান অবিলম্বে সাবান ও জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন এবং ডাক্তারের কাছ থেকে র্যাবিজের টিকা নিন। পুরো ডোজ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী, যাতে শরীর ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকে।
কি র্যাবিজ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব?
হ্যাঁ, সময়মতো চিকিৎসা করা হলে র্যাবিজ থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কুকুর কামড়ালে, ক্ষত স্থান অবিলম্বে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন এবং ডাক্তারের সাথে দেখা করে র্যাবিজের টিকা নিন। এই চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরী, কারণ র্যাবিজ একটি গুরুতর রোগ যা দ্রুত ছড়াতে পারে। চিকিৎসার সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পুরো প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করুন।
সতর্কতা এবং সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনাকে বা আপনার কোনো পরিচিতকে কুকুর কামড়ায়, তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসা সাহায্য নিন। এটি আপনার জীবনকে সুরক্ষিত রাখার সর্বোত্তম উপায়।
র্যাবিজ এমন একটি রোগ যার চিকিৎসা তখন পর্যন্ত সম্ভব যতক্ষণ না তার লক্ষণ শুরু হয়। শিশু জিয়ার মৃত্যু আমাদের সকলের জন্য একটি সতর্কবার্তা যে কুকুরের কামড়কে কখনোই ছোটো করে দেখা উচিত নয়। ক্ষত ছোটো হোক বা বড়ো, সঠিক চিকিৎসা এবং সময়মতো টিকাই আপনার বা আপনার সন্তানদের প্রাণ রক্ষা করতে পারে।
```