একে-৪৭ রাইফেল বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ও মারাত্মক অটোমেটিক রাইফেলগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত। ১৯৪৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিখাইল কালাশনিকভ কর্তৃক ডিজাইন করা, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর স্থায়িত্ব, সরলতা এবং কঠিন আবহাওয়ার অবস্থায়ও কার্যকরী থাকার ক্ষমতা।
একে-৪৭ রাইফেলের গুণাবলী: সম্প্রতি পুলওয়ামায় সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা আবারও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে এমন একটি অস্ত্রের গুরুত্ব যার নাম শুনলেই ভয় লেগে যায়: একে-৪৭ রাইফেল। সন্ত্রাসবাদীরা নির্দোষ পর্যটকদের লক্ষ্য করে এই বিপজ্জনক অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এই কাপুরুষোচিত কাজ সর্বজনীনভাবে নিন্দিত হয়েছে এবং ভারত সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আজ আমরা সেই অস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করব যা দশকের পর দশক ধরে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রগুলির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
একে-৪৭ শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারাই নয়, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারাও ব্যবহৃত হয়। এই রাইফেলকে এতটা বিশেষ কি করে তোলে যা 'মৃত্যুযন্ত্র' হিসেবে বিবেচিত হয়? আসুন বিস্তারিত জেনে নিই।
একে-৪৭ এর ইতিহাস
একে-৪৭ এর পুরো নাম অ্যাভটোমাট কালাশনিকোভা ১৯৪৭। এটি ১৯৪৭ সালে সোভিয়েত সৈনিক মিখাইল কালাশনিকভ কর্তৃক তৈরি করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, কালাশনিকভ তার উদ্ভাবন থেকে কোনো লাভ পাননি, এটি সোভিয়েত সেনাবাহিনীর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। আজ, এই রাইফেল বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলির মধ্যে একটি।
কেন এটি একটি প্রিয় অস্ত্র?
- অত্যন্ত সহজ ব্যবহার: একে-৪৭ ব্যবহারের জন্য কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। এটি এত সহজে পরিচালনা করা যায় যে ছোট ছেলেরাও এটি ব্যবহার করতে পারে। এ কারণেই সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে শুরু করে সামরিক একাডেমী সব জায়গায় এর চাহিদা রয়েছে।
- সকল অবস্থায় নির্ভরযোগ্য: একে-৪৭ যেকোনো আবহাওয়া বা অবস্থায় কাজ করে—ধুলোবালির ঝড়, প্রবল বৃষ্টি, অথবা জলাবদ্ধ ভূমি, কোনোটাই এর দক্ষতাকে প্রভাবিত করে না। এই গুণাবলী এটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে অদম্য করে তোলে।
- সহজ রক্ষণাবেক্ষণ: একে-৪৭ মাত্র ৮টি অংশ নিয়ে গঠিত। এটিকে খুলে ফেলা এবং জোড়া লাগানো এত সহজ যে মাত্র এক মিনিটে মেরামত করা যায়। এর সরলতা এবং স্থায়িত্ব এটিকে একটি আদর্শ যুদ্ধাস্ত্র করে তোলে।
প্রযুক্তিগত তথ্য
- এই রাইফেল ৭.৬২x৩৯ মিমি বুলেট ব্যবহার করে, যা অত্যন্ত কার্যকর বলে বিবেচিত।
- পুরোপুরি অটোমেটিক মোডে, একে-৪৭ প্রতি মিনিটে প্রায় ৬০০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে পারে।
- এর গুলির পাল্লা প্রায় ৩৫০ মিটার, কিন্তু দক্ষ শ্যুটাররা ৮০০ মিটার পর্যন্ত এটি কার্যকরীভাবে ব্যবহার করতে পারে।
- এর ম্যাগাজিন বিভিন্ন ধরণের আসে—২০-রাউন্ড, ৩০-রাউন্ড এবং ৭৫-রাউন্ড ড্রাম ম্যাগাজিন।
- এটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬টি গুলি ছুড়তে পারে।
- এর গুলি এত শক্তিশালী যে দেওয়াল, গাড়ির দরজা অথবা শক্ত কাঠের বাধা ভেদ করতে পারে।
কেন এটি সন্ত্রাসবাদীদের প্রথম পছন্দের অস্ত্র?
একে-৪৭ এর নির্ভুলতা, স্থায়িত্ব এবং দ্রুত গুলি ছোড়ার হার এটিকে সন্ত্রাসবাদীদের জন্য আদর্শ করে তোলে। অস্ত্রটি বেশি রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই দীর্ঘ সময় স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি এর কম দামও সন্ত্রাসবাদীদের কাছে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। চুরি, পাচার এবং অবৈধ ব্যবসা এটিকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাছে সহজলভ্য করে তোলে।
সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যও আদর্শ
ভারত সহ অনেক দেশের সেনাবাহিনী একে-৪৭ এর বিশেষ সংস্করণ ব্যবহার করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর কিছু ইউনিট এখনও একে-৪৭ ব্যবহার করে, বিশেষ করে কঠিন অবস্থায় যুদ্ধের প্রয়োজন হলে। যদিও অনেক আধুনিক রাইফেল এখন পাওয়া যায়, তবুও একে-৪৭ এর নির্ভরযোগ্যতা অতুলনীয়।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বা তার বেশি একে-৪৭ রাইফেল রয়েছে। এর প্রচুরতা প্রায়শই উল্লেখ করা হয় যে বিশ্বে প্রতি ৭০ জনের জন্য একটি একে-৪৭ রয়েছে। এ কারণেই এটিকে "বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাইফেল" বলা হয়।
একে-৪৭ রাইফেল শুধুমাত্র একটি অস্ত্র নয়; এটি যুদ্ধ, সংঘাত এবং বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এর সরলতা, ক্ষমতা এবং বহুমুখীতা এটিকে অনন্য করে তুলেছে। তবে, যখন এই বিপজ্জনক অস্ত্র নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তখন এটি মানবতার উপর গভীর আঘাত করে। পুলওয়ামার মতো ঘটনা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রযুক্তির অপব্যবহার কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে।