ঐতিহ্যগত স্কুলের অবক্ষয়: কোচিং সেন্টারের দিকে ছাত্রদের ঝোঁক এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত

🎧 Listen in Audio
0:00

বর্তমান সময়ে একটি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেখানে বহু সংখ্যক ছাত্র ঐতিহ্যগত স্কুলের শিক্ষা ছেড়ে পুরোদমে কোচিং প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে।

ভারতে শিক্ষার চেহারা গত কয়েক বছরে দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে। একদিকে যেখানে স্কুল শিক্ষাকে শিশুদের সার্বিক বিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখা হতো, সেখানে অন্যদিকে কোচিং সেন্টার এখন শিক্ষার নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ৯ম থেকে ১২শ্রেণীর ছাত্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ঐতিহ্যগত স্কুল থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পুরোদমে কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। এই প্রবণতাই ডামি স্কুলের প্রচলনকে জন্ম দিয়েছে, যেখানে ছাত্রদের উপস্থিতি কেবল নামমাত্র, আসল পড়াশোনা কোচিং প্রতিষ্ঠানে হয়। এই বর্ধমান প্রবণতাকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কি কি ডামি স্কুল এবং কেন জনপ্রিয় হচ্ছে

ডামি স্কুল হলো এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেগুলি ছাত্রদের কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে নাম নথিভুক্ত রাখে যাতে তারা বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তাদের প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। ছাত্ররা তাদের অধিকাংশ সময় কোচিং সেন্টারে কাটায়, যেখানে তাদের JEE, NEET এর মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য গहन প্রস্তুতি দেওয়া হয়।

এই স্কুলগুলির প্রচলন বেড়েছে কারণ স্কুলের নিয়মিত পড়াশোনা এবং বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ধরণের সাথে মেলে না। ছাত্র ও অভিভাবকরা মনে করেন কোচিং সেন্টারে পাওয়া বিশেষ কৌশল এবং টেস্ট সিরিজ তাদের উন্নত ফলাফল আনতে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোরতা

কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ডামি স্কুলের বর্ধমান প্রভাব, কোচিং শিল্পের ভূমিকা এবং এর অপপ্রভাবের তদন্তের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিতে CBSE-র চেয়ারম্যান, IIT কানপুর, IIT মাদ্রাজের মতো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে স্কুলগুলির কোন কোন ত্রুটি রয়েছে, যার ফলে ছাত্ররা কোচিংয়ে নির্ভরশীল হচ্ছে।

স্কুল শিক্ষা বনাম কোচিং: কেন পার্থক্য

আজকের ছাত্র স্কুল থেকে প্রত্যাশা করে যে তাকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করবে। কিন্তু স্কুলগুলিতে রট্টা তত্ত্বভিত্তিক পড়াশোনা, সীমিত ব্যবহারিক জ্ঞান এবং বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতার অভাব ছাত্রদের হতাশ করে। অন্যদিকে কোচিং প্রতিষ্ঠান দ্রুত গতিতে সিলেবাস শেষ করে, নিয়মিত পরীক্ষা নেয় এবং শিশুদের মানসিকভাবে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে।

কমিটি এখন এই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে যে স্কুল শিক্ষায় সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা এবং উদ্ভাবনের উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কিনা। পাশাপাশি দেখা হবে যে গঠনমূলক মূল্যায়নের আওতায় ছাত্ররা কতটা বোঝাপড়া পাচ্ছে।

কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন নীতি নিয়ে প্রশ্ন

আজ কোচিং সেন্টার তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছাত্রদের প্রভাবিত করার কাজ করে। টপার্সের ছবি, লক্ষ লক্ষ টাকার বৃত্তি, সীমিত সময়ে সফলতার দাবি – এগুলি সব ছাত্র ও অভিভাবকদের আকর্ষণ করে। কমিটিকে কোচিং সেন্টারগুলির এই বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের পর্যালোচনা করার এবং এর জন্য নির্দেশিকা পরামর্শ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন কেবলমাত্র কয়েকজন সফল ছাত্রের গল্প বলে, তবে বাকি হাজার হাজার ছাত্রের ব্যর্থতা এবং মানসিক চাপের আলোচনা হয় না। এটিও একটি বড় কারণ যার ফলে অনেক ছাত্র মানসিক চাপ, হতাশা এবং আত্মহত্যার মতো গুরুতর পদক্ষেপ নেয়।

কোচিং সেন্টারের জন্য নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রয়োজন

কোচিং শিল্প দেশে একটি অনিয়ন্ত্রিত ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এর জন্য কোনো মান নির্ধারিত হয়নি এবং তদারকির কোনো সুদৃঢ় ব্যবস্থা নেই। সংসদীয় কমিটি সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছে যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি জাতীয় নীতি তৈরি করতে হবে যা কোচিং সেন্টারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

এই নীতিতে ফি স্ট্রাকচার, শিক্ষাগত মান, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং ছাত্র সুরক্ষা এর মতো বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে কোচিং সেন্টার পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্রদের সার্বিক বিকাশেও মনোযোগ দেয়।

আসন কম, প্রতিযোগিতা বেশি

একটি প্রধান কারণ যার ফলে ছাত্ররা কোচিংয়ের আশ্রয় নেয়, তা হল সীমিত আসন এবং বর্ধমান প্রতিযোগিতা। JEE এবং NEET এর মতো পরীক্ষায় লক্ষ লক্ষ ছাত্র অংশগ্রহণ করে, কিন্তু আসন কয়েক হাজার। এমন পরিস্থিতিতে সফলতার জন্য অতিরিক্ত প্রস্তুতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি এই বিষয়েও বিবেচনা করছে যে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসনের সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো যায় যাতে ছাত্রদের উপর চাপ কমাতে পারে।

ক্যারিয়ার গাইডেন্সের ভূমিকা

আজও অনেক স্কুলে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বা পরামর্শের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। ছাত্র ও অভিভাবকরা কেবলমাত্র মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিংকেই ভবিষ্যৎ বলে মনে করেন। এমন পরিস্থিতিতে ক্যারিয়ার গাইডেন্স ফ্রেমওয়ার্ককে শক্তিশালী করার প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা হলো স্কুল পর্যায় থেকেই ছাত্রদের বিভিন্ন ক্যারিয়ারের বিকল্প সম্পর্কে অবহিত করা।

যদি ছাত্রদের সময়মতো বিকল্প এবং আগ্রহভিত্তিক ক্ষেত্রের তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে তারা কেবলমাত্র কিছু সীমিত বিকল্পে আটকে না পড়ে, বরং উন্নত এবং বৈচিত্র্যময় সুযোগের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

কমিটির প্রত্যাশিত প্রতিবেদন এবং পরামর্শ

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তার প্রতিবেদন জমা দেবে। আশা করা হচ্ছে এই প্রতিবেদনে নিম্নলিখিত পরামর্শগুলি সামনে আসতে পারে:

ডামি স্কুল নিয়ে কঠোরতা এবং বৈধতার স্পষ্টতা

  • কোচিং সেন্টারের জন্য জাতীয় নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রতিষ্ঠা
  • স্কুল শিক্ষাকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত করার পরামর্শ
  • ক্যারিয়ার গাইডেন্সকে শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা
  • মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রসার এবং তদারকি
  • আসনের সংখ্যায় সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধি

Leave a comment