পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী

🎧 Listen in Audio
0:00

পশ্চিম এশিয়ায় বর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব বিশ্ববাজারের তেলের উপর দেখা দিতে শুরু করেছে। গত কয়েক মাস ধরে যেখানে কাঁচা তেলের দাম কমছিল, সেখানে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: পশ্চিম এশিয়া আবারও ভূ-রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের উপর সম্প্রতি করা সামরিক আক্রমণের পর বিশ্ববাজারে তোলপাড় শুরু হয়েছে এবং এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কাঁচা তেলের দামের উপর। শুক্রবার তেলের দাম প্রায় ৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বেড়েছে এবং আমেরিকা, চীন ও ইউরোপের মতো প্রধান ভোক্তা দেশগুলিতেও শক্তি সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শুক্রবার কি ঘটেছিল?

শুক্রবার ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছে যে তারা ইরানের রাজধানী তেহরান এবং তার আশপাশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছে। ইসরায়েলের দাবি, এই আক্রমণ ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইরানের গণমাধ্যম জানিয়েছে তেহরান ও অন্যান্য এলাকায় জোরালো বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, যদিও সরকারিভাবে এই আক্রমণের পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

কাঁচা তেলের দাম কেন বৃদ্ধি পেল?

এই আক্রমণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। ব্রেন্ট ক্রুড ফিউচার্স ৭.৬৩% বৃদ্ধি পেয়ে ৭৪.৬৫ ডলার প্রতি ব্যারেল এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) ক্রুড ৭.৯১% বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩.৪২ ডলার প্রতি ব্যারেল দাঁড়িয়েছে। এটি ২ এপ্রিল ২০২৫-এর পর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি বলে মনে করা হচ্ছে।

এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ হল বাজারে আশঙ্কা রয়েছে যে যদি সংঘর্ষ আরও গভীর হয়, তবে ইরান হরমুজ जलडमरूमध्य বন্ধ করার হুমকি দিতে পারে। এই পথ দিয়েই বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ তেল ট্যাংকার চলাচল করে। যদি এই পথের সরবরাহ ব্যাহত হয়, তবে কাঁচা তেলের দাম ১০০ ডলার প্রতি ব্যারেল ছাড়িয়ে যেতে পারে।

আমেরিকার স্পষ্ট অবস্থান: আমরা জড়িত নই

এই পুরো ঘটনার মধ্যে আমেরিকা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা ইসরায়েলের আক্রমণে কোনওভাবেই জড়িত নয়। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিয়ো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "এটি ইসরায়েলের একতরফা পদক্ষেপ। আমরা এই সামরিক অভিযানের অংশ নই।" তিনি ইরানের কাছে আবেদন করেছেন যাতে তারা আমেরিকার সৈন্য বা দূতাবাসকে লক্ষ্য করে না।

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে আমেরিকা এবার যে কোনো ধরনের সরাসরি সামরিক জড়িত থেকে দূরে থাকতে চায়, বিশেষ করে যখন তারা ইতোমধ্যে ইউক্রেন এবং তাইওয়ান নিয়ে বিশ্বব্যাপী মঞ্চে বহু মোর্চায় লড়াই করছে।

যদি সংঘর্ষ আরও গভীর হয়?

তেল বিশ্লেষক ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই সংঘর্ষ আরও এগিয়ে যায় এবং ইরান তাদের তেল উৎপাদন বা পরিবহনের উপর হুমকি বাস্তবায়ন করে, তবে বিশ্ব তেল বাজারে ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। MST Marquee-এর শক্তি বিশ্লেষক সল কাভনিক বলেছেন, যদি ইরান হরমুজ जलडमरूमध्य বন্ধ করে দেয় বা তাদের তেল অবকাঠামোর উপর নিজেই নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তবে প্রতিদিন ২ কোটি ব্যারেল পর্যন্ত সরবরাহ প্রভাবিত হতে পারে। এটি বিশ্ব অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে তুলবে।

ভারত ও অন্যান্য আমদানিকারক দেশের উপর প্রভাব

ভারত, যা তার ৮৫% এর বেশি তেলের চাহিদা আমদানির উপর নির্ভর করে, এই সংকটের কারণে গুরুতরভাবে প্রভাবিত হতে পারে। কাঁচা তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশীয় জ্বালানি দামের দ্রুত বৃদ্ধি হতে পারে, যার ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। পেট্রোল ও ডিজেলের সাথে সাথে পরিবহন এবং খাদ্যপণ্যের দামও বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার আর্থিক নীতির উপরও চাপ বাড়বে।

ইসরায়েলের উদ্দেশ্য স্পষ্ট: ইরানের পারমাণবিক কাঠামো ধ্বংস করা

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই আক্রমণ ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য করা হয়েছে। তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন যে, প্রয়োজন হলে ইসরায়েল ভবিষ্যতেও পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। তার মতে, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র এবং অন্যান্য সামরিক প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করা প্রয়োজন ছিল।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন এই আক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং উভয় পক্ষকে সংযমী হতে আহ্বান জানিয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি দ্রুত কোন মধ্যস্থতা না হয়, তবে এই সংঘর্ষ আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে, যাতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইরাকের মতো আঞ্চলিক দেশও পরোক্ষভাবে জড়িত হতে পারে। এর ফলে কেবল তেলের দামের উপর নয়, বিশ্ববাজারের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়বে।

Leave a comment