ভারত পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (POK) -এ অবস্থিত সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে অপারেশন সিন্দুর পরিচালনা করেছে। ২০২৯ সালে বালাকোট অপারেশনের পর থেকে এটি ভারতের দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে বড় সীমান্ত-পার সুনির্দিষ্ট আঘাত ছিল।
নয়াদিল্লি: ভারতীয় সেনা পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (PoK)-এ অবস্থিত সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটিতে দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট আঘাত হানে, যা অপারেশন সিন্দুর নামে পরিচিত। ২০২৯ সালে বালাকোটের পর এটি ভারতের দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে বড় সীমান্ত-পার আঘাত। ভারতীয় সেনারা আধুনিক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে প্রচণ্ড ক্ষতি সাধন করে।
এতে স্ক্যাল্প ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, হ্যামার প্রিসিশন বোমা এবং লয়েটারিং মিউনিশন সহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অপারেশন কেবলমাত্র পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি ধ্বংসই করেনি, বরং সমগ্র বিশ্বকেও এই বার্তা দিয়েছে যে ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।
অপারেশন সিন্দুর: অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার
অপারেশন সিন্দুরে ভারতীয় সেনা অত্যাধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে প্রধান অস্ত্রগুলির মধ্যে রয়েছে স্ক্যাল্প ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, হ্যামার প্রিসিশন বোমা এবং লয়েটারিং মিউনিশন।
১. স্ক্যাল্প ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র (SCALP-EG/Storm Shadow)
এটি একটি দীর্ঘ পাল্লার, কম দৃশ্যমানতা সম্পন্ন, বায়ু থেকে ভূমি লক্ষ্যবস্তু ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। এটি ফ্রান্স এবং ব্রিটেন যৌথভাবে উন্নয়ন করেছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ৩৬টি রাফেল যুদ্ধবিমানে এই ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
স্ক্যাল্পের বৈশিষ্ট্য
- পাল্লা- ২৫০-৫৬০ কিমি (ক্ষেপণের উচ্চতার উপর নির্ভর করে)
- গতি- সাবসনিক, Mach 0.8 (প্রায় ১০০০ কিমি/ঘন্টা)
- ওজন- প্রায় ১৩০০ কিলোগ্রাম
- পথনির্দেশ ব্যবস্থা- GPS এবং নেভিগেশন
- ইনফ্রারেড সিকার- লক্ষ্যের থার্মাল ছবির উপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত পর্যায়ে পথনির্দেশনা
- টেরেন রেফারেন্স নেভিগেশন- অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে উড়ান, যা রাডার থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।
- উড়ানের উচ্চতা- ১০০ থেকে ১৩০ ফুট কম উচ্চতায় উড়ান, যা এটিকে রাডার থেকে বাঁচতে সক্ষম করে।
২. হ্যামার (Highly Agile Modular Munition Extended Range)
হ্যামার একটি স্মার্ট বোমা যা বিশেষ করে শক্তিশালী কাঠামো যেমন বাংকার এবং বহুতল ভবন আক্রমণ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই বোমা ৫০-৭০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ্য করতে পারে এবং এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ ব্যবস্থা রয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে বোমা সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে।
৩. লয়েটারিং মিউনিশন (Loitering Munition)
এই মিউনিশনকে আত্মঘাতী ড্রোনও বলা হয়। এটি একটি মানববিহীন আকাশযান অস্ত্র যা লক্ষ্যবস্তুর উপরে মন্ডরাইতে থাকে এবং তারপর আক্রমণ করে। একবার লক্ষ্যবস্তু পেলে এটি তা ধ্বংস করে দেয়। এটি একটি সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর অস্ত্র, যা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে অত্যন্ত কার্যকর।
অপারেশন সিন্দুর: পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি লক্ষ্য
অপারেশন সিন্দুরের সময় ভারতীয় সেনা মোট ৯টি প্রধান স্থানে আক্রমণ করে, যার মধ্যে ৪টি পাকিস্তানে এবং ৫টি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত ছিল। সমস্ত স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল বিশেষ করে সেই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে যারা ভারতে সন্ত্রাসবাদ ছড়াতে জড়িত ছিল।
- মুরিডকে (Muridke): এটি লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রধান শিবির ছিল, যা আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। এই শিবির থেকে সন্ত্রাসবাদীরা ভারতে অনুপ্রবেশ করত।
- গুলেপুর (Gulpur): এই সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি পুঞ্চ-রাজৌরির কাছে LOC থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। এখানে সন্ত্রাসবাদীদের সীমান্ত পারাপার করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
- লস্কর ক্যাম্প সওয়াই (Lashkar Camp Sawai): এই সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের তাঙ্গধার সেক্টরে অবস্থিত ছিল, যা ভারতীয় সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল।
- বিল্লাল ক্যাম্প (Bilal Camp): জইশ-ই-মোহাম্মদের এই লঞ্চপ্যাড থেকে সন্ত্রাসবাদীদের সীমান্ত পারাপার করার কাজ করা হত। এই ক্যাম্পও অপারেশন সিন্দুরের আওতায় লক্ষ্যবস্তু ছিল।
- কোটলি (Kotli): এটি লস্কর-ই-তৈয়বার শিবির ছিল, যা LOC থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। এখানে ভারতীয় সীমান্তে অনুপ্রবেশের জন্য সন্ত্রাসবাদীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
- বারনাল ক্যাম্প (Barnala Camp): এই ক্যাম্প LOC থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল, যেখানে হিজবুল মুজাহিদিনের সন্ত্রাসবাদীরা প্রশিক্ষণ নিত।
- সরজাল ক্যাম্প (Sarjal Camp): এটি জইশ-ই-মোহাম্মদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল, যা আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। এখান থেকে সন্ত্রাসবাদীদের ভারতীয় সীমান্তে অনুপ্রবেশের জন্য পাঠানো হত।
- মেহমুনা ক্যাম্প (Mehmuna Camp): এটি হিজবুল মুজাহিদিনের একটি প্রশিক্ষণ শিবির ছিল, যা আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্পষ্ট করেছে যে এই অপারেশনে কোনও পাকিস্তানি সামরিক প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করা হয়নি। সমস্ত আক্রমণ বিশেষ করে সেই ঘাঁটিগুলিতে করা হয়েছিল যা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি তাদের অপারেশন কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করছিল। মন্ত্রণালয়ের মতে, এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ছিল এবং এর উদ্দেশ্য নিরপরাধ নাগরিকদের ক্ষতি করা ছিল না।
অপারেশন সিন্দুরের পর পাকিস্তান, চীন এবং তুরস্কের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। পাকিস্তান এই পদক্ষেপকে তাদের অঞ্চলীয় অধিকার লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেছে। চীনও ভারতের এই পদক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে উভয় দেশকে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আত্মরক্ষার অধিকার সমর্থন করেছে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে।