মাঝারি উদ্যোগ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্ব ও উন্নয়নের পথ

মাঝারি উদ্যোগ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্ব ও উন্নয়নের পথ
সর্বশেষ আপডেট: 26-05-2025

দেশের অর্থনীতিতে MSME (সূক্ষ্ম, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) খাতের গুরুত্ব অস্বীকার্য। এই খাত শুধুমাত্র কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় উৎস নয়, রপ্তানি ও উৎপাদনেও এর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি নীতি আয়োগ ‘ডেজিং এ পলিসি ফর মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে মাঝারি উদ্যোগগুলির বর্তমান অবস্থা, তাদের সম্ভাব্য অবদান এবং উন্নয়নের পথে আসা প্রতিবন্ধকতাগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের মতে, যদি মাঝারি উদ্যোগগুলির উৎপাদন ২০% বৃদ্ধি পায়, তাহলে দেশে প্রায় ১২ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন দেশের ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগগুলি মাঝারি উদ্যোগে রূপান্তরিত হতে আগ্রহী নয়? আসুন, নীতি আয়োগের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই বিষয়টি বুঝে নেওয়া যাক।

মাঝারি উদ্যোগের দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্ব

ভারতের মোট GDP-তে MSME খাতের অবদান প্রায় ২৯%। এছাড়াও, এই খাতের Gross Value Added (GVA)-তে ৩১.৮% এবং মোট রপ্তানিতে প্রায় ৪৫% অংশগ্রহণ রয়েছে। দেশের প্রায় ৬২% কর্মী MSME খাতে কর্মরত। এই তথ্যগুলিই এই খাতের গুরুত্ব স্পষ্ট করে।

MSME খাতে প্রায় ৬ কোটি অ-কৃষি ইউনিট কর্মরত, যার অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও লঘু শ্রেণীর। নীতি আয়োগের প্রতিবেদনের মতে, মাত্র ০.৩%ই মাঝারি উদ্যোগ। সংখ্যার দিক থেকে এটি খুবই কম, তবে কর্মসংস্থান ও রপ্তানির ক্ষেত্রে মাঝারি উদ্যোগগুলির অবদান disproportionate অর্থাৎ অনুপাতের বাইরে।

প্রতি ইউনিট কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মাঝারি উদ্যোগগুলি ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগগুলির থেকে অনেক এগিয়ে। একটি মাঝারি উদ্যোগে গড়ে ৮৯.৪ জন কর্মী কাজ করেন, যখন লঘু উদ্যোগে ১৯.১১ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগে মাত্র ৫.৭০ জন কর্মী থাকে। এই কারণেই মাঝারি উদ্যোগে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।

রপ্তানির ক্ষেত্রেও মাঝারি উদ্যোগগুলির অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মোট MSME রপ্তানির প্রায় ৪০% অংশ মাঝারি উদ্যোগগুলির, যদিও ৯১% রপ্তানিকারী ইউনিট ক্ষুদ্র ও লঘু শ্রেণীর যারা ৬০% রপ্তানি করে। মাঝারি উদ্যোগগুলির গড় বৈদেশিক মুদ্রা আয় ৩৯.৫ কোটি টাকা, যা লঘু (৮.৩ কোটি) এবং ক্ষুদ্র (১.৩৯ কোটি) উদ্যোগের তুলনায় অনেক গুণ বেশি।

উন্নয়নের পথে বড় বাধা

নীতি আয়োগের প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে যে, কেন ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগগুলি মাঝারি উদ্যোগে রূপান্তরিত হতে দ্বিধা করে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো সরকারি পরিকল্পনা এবং ঋণ সহায়তার বণ্টন। অধিকাংশ সরকারি পরিকল্পনা ও অর্থায়ন ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগগুলির জন্য বেশি উপলব্ধ।

২০২২-২৩ অর্থবর্ষে MSME খাতের জন্য মোট ৫,৪৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ১৭.৮১%ই মাঝারি উদ্যোগগুলির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অধিকাংশ তহবিল প্রধানমন্ত্রী রোজগার গ্যারান্টি যোজনা এবং PM বিশ্বকর্মা যোজনা ইত্যাদি পরিকল্পনায় ব্যয় হয়, যা বিশেষ করে মাঝারি উদ্যোগগুলির জন্য নয়।

এর সরাসরি ফলাফল হলো, ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগগুলি ছোট থাকাকেই অগ্রাধিকার দেয় যাতে তারা সরকারি সাহায্য ও ভর্তুকি পেতে পারে। ফলে তারা তাদের ব্যবসার প্রসার করে মাঝারি উদ্যোগে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি নেয় না। এই মানসিকতা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও, মাঝারি উদ্যোগগুলির জন্য লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনার অভাবের কারণে তারা বিশ্ববাজারে তাদের পুরো ক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। এই কারণে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাঝারি উদ্যোগগুলির অবদান প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না।

আগামী পথ: নীতি পরিবর্তন ও সমর্থন প্রয়োজন

নীতি আয়োগের প্রতিবেদন স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দেশকে MSME খাতে মাঝারি উদ্যোগগুলির উন্নয়নে বিশেষ নজর দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন, সরকার বিশেষ পরিকল্পনা করে মাঝারি উদ্যোগগুলিকে উন্নতমানের ঋণ, প্রযুক্তিগত সাহায্য এবং বাজারের সুযোগ প্রদান করবে।

মাঝারি উদ্যোগগুলির আকার বড় হওয়ার কারণে এগুলিতে উদ্ভাবন (Innovation) এবং কার্যকরী দক্ষতা (Operational Efficiency) বৃদ্ধির বেশি সম্ভাবনা থাকে। যদি এগুলিকে সঠিক দিকে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে এগুলো কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং দেশের রপ্তানি ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করতে পারে।

এর সাথে সাথে, সরকারের নীতিগুলি এমন হওয়া উচিত যাতে ক্ষুদ্র ও লঘু উদ্যোগগুলিও কোনো ভয় বা আর্থিক বাধা ছাড়াই তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করে মাঝারি উদ্যোগে পরিণত হতে পারে। এতে শুধুমাত্র তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিই হবে না, তারা বিশ্ববাজারেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে।

নীতি আয়োগের এই প্রতিবেদন আমাদের MSME খাতের বর্তমান অবস্থা এবং এর সম্ভাবনাগুলির একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। এটি বলে যে, যদি মাঝারি উদ্যোগগুলিকে যথাযথ সহযোগিতা এবং আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়, তাহলে তারা ১২ লক্ষেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

Leave a comment