ই-ফার্মেসি প্ল্যাটফর্ম: সরকারের কঠোর নজরদারিতে

ই-ফার্মেসি প্ল্যাটফর্ম: সরকারের কঠোর নজরদারিতে
সর্বশেষ আপডেট: 17-06-2025

১০ থেকে 60 মিনিটের মধ্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ই-ফার্মেসি প্ল্যাটফর্মগুলি এখন সরকারের কঠোর নজরদারিতে চলে এসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই প্ল্যাটফর্মগুলির কার্যপ্রণালী নিয়ে গুরুতরভাবে উদ্বিগ্ন এবং শীঘ্রই এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি নতুন আইন আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নয়াদিল্লি: ভারতে অনলাইনে ওষুধ কেনা এখন সাধারণ হয়ে উঠছে, কিন্তু এই ডিজিটাল সুবিধার বর্ধিত ব্যবহার সরকারের উদ্বেগও বাড়িয়ে তুলেছে। ১০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে ওষুধ ডেলিভারির দাবি করা কোম্পানিগুলিকে এখন সরকার কড়া নজরে রাখছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন এই সমগ্র ক্ষেত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি নতুন এবং বিশেষ আইন আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য ই-ফার্মেসি প্ল্যাটফর্মগুলির জবাবদিহিতা নির্ধারণ করা এবং রোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

দ্রুত বর্ধমান ডিজিটাল ফার্মেসি বাজার

কোভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে দেশে অনলাইন মেডিকেল সেবার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মানুষের প্রাথমিকতা হয়ে উঠেছে বাড়ি বসেই ওষুধ মঙ্গানো। এটিকে দেখে Tata 1mg, Netmeds, PharmEasy, Apollo 24|7 এর মতো বড় ব্র্যান্ডগুলির পাশাপাশি অনেক স্টার্টআপও এই ক্ষেত্রে নেমে এসেছে। সম্প্রতি PhonePe-র 'Pincode' এবং Zeelab Pharmacy এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলি ১০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার সেবা শুরু করেছে।

যদিও এই সেবা একদিকে গ্রাহকদের জন্য উপকারী মনে হচ্ছে, অন্যদিকে এর পরিচালনা ও প্রক্রিয়ায় অবহেলার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। সরকারের কাছে এমন অনেক অভিযোগ এসেছে যেখানে এই কোম্পানিগুলিকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করা, স্টোরের পরিচ্ছন্নতায় অবহেলা এবং সংবেদনশীল ওষুধের নির্দেশনা ছাড়া বিক্রয়ের মতো অভিযোগ করা হয়েছে।

রোগীদের সুরক্ষা নিয়ে বিপদ

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার মতে, ই-ফার্মেসি কোম্পানিগুলি নিয়ে যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা এখন এতটাই গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ না করলে ভবিষ্যতে রোগীদের সুরক্ষা নিয়ে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু কোম্পানি শক্তিশালী ওষুধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড এবং ঘুমের ওষুধও বৈধ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই সরবরাহ করছে, যা সরাসরি স্বাস্থ্যের সাথে লড়াই করা।

এতটুকুই নয়, ডেলিভারির জন্য ব্যবহৃত 'ডার্ক স্টোর' বা গুদাম নিয়েও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই স্টোরগুলিতে পরিচ্ছন্নতা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধের নিরাপদ সঞ্চয়ের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। এর ফলে ওষুধের গুণমানের উপর প্রভাব পড়তে পারে, যা রোগীর স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

আইনের অভাব এবং নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

ভারতে এখনও পর্যন্ত অনলাইনে ওষুধ বিক্রির জন্য কোন স্পষ্ট এবং নিবেদিত আইন নেই। বর্তমান 'Drugs and Cosmetics Act, 1940'-এ কেবলমাত্র ওষুধের ঐতিহ্যগত বিক্রয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের পরিচালনা, স্টকিং, প্রেসক্রিপশনের বৈধতা, ডেটা সুরক্ষা এবং জরুরী অবস্থায় জবাবদিহিতা নিয়ে কোন স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। यही কারণে সরকার এই প্ল্যাটফর্মগুলির বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অক্ষম বোধ করছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন এই ঘাটতি দূর করার জন্য একটি নতুন আইন আনার দিকে দ্রুত কাজ করছে, যাতে ই-ফার্মেসি নিয়ে বিস্তৃত বিধান অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই আইনের মাধ্যমে ওষুধ বিক্রিতে স্বচ্ছতা, রোগীদের সুরক্ষা, প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং দায়িত্বশীল পরিচালনা নিশ্চিত করা হবে।

গ্রাহক সংখ্যায় ব্যাপক বৃদ্ধি

Crisil-এর প্রতিবেদনের মতে, ভারতের খুচরা ফার্মেসি বাজার প্রায় ২.৪ লক্ষ কোটি টাকার। এর মধ্যে মাত্র ৩-৫ শতাংশই বর্তমানে ই-ফার্মেসির, যখন আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশে এটি ২২-২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। প্রতিবেদন বলে যে, যদি এই ক্ষেত্রটিকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে ভারতে ই-ফার্মেসির অবদান আগামী বছরগুলিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

দেশের অধিকাংশ অংশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চল এবং আধা-শহরাঞ্চলে অনলাইন ওষুধের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধ, অসুস্থ বা ব্যস্ত জীবনযাপনকারীরা ডিজিটাল ফার্মেসিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু যতই এই সুবিধা বাড়ছে, ততই এর ত্রুটি ও ঝুঁকির আশঙ্কাও সামনে আসছে।

ই-ফার্মেসির ইতিবাচক সম্ভাবনা

সরকারের উদ্বেগ সত্ত্বেও, ই-ফার্মেসি মডেলকে সম্পূর্ণ দোষী বলা যায় না। যদি এই ক্ষেত্রটিকে একটি সুশৃঙ্খলভাবে বিকশিত করা হয় এবং কোম্পানিগুলিকে নির্দিষ্ট মান অনুসারে পরিচালনা করার জন্য বাধ্য করা হয়, তাহলে এটি ভারতের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও সহজলভ্য করে তুলতে পারে।

ডিজিটাল ফার্মেসির সাহায্যে দূরবর্তী অঞ্চলেও উন্নতমানের ওষুধ পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে, যেখানে ঐতিহ্যগত মেডিকেল স্টোর কম বা নেইই। এছাড়াও, ডিজিটাল রেকর্ড, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশনের যাচাই এবং অটোমেটেড স্টক ম্যানেজমেন্টের মতো প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবাকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে।

কোম্পানিগুলিকে জবাবদিহী করার প্রয়োজন

সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে সমস্ত ই-ফার্মেসি প্ল্যাটফর্মের জন্য একটি একক নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা, যাতে এটি নিশ্চিত করা যায় যে কেবলমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলিতেই ওষুধ বিক্রি করতে পারবে। এর সাথে সাথে একটি কেন্দ্রীকৃত নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করা হবে, যা প্রেসক্রিপশনের যাচাই, ডেলিভারির অবস্থা এবং রোগীর প্রতিক্রিয়া ট্র্যাক করতে পারবে।

সরকার সেইসব কোম্পানিগুলিকেও নজরে রাখবে যারা সময়সীমার মধ্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নিয়মকানুন উপেক্ষা করছে। নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অধীনে 'দ্রুত ডেলিভারি' প্রক্রিয়াটিকে নিরাপদ ও নিয়ন্ত্রিত করা অপরিহার্য হবে।

Leave a comment