বড় মঙ্গল: জ্যৈষ্ঠ মাসের পবিত্র উৎসব ও হনুমানজীর কৃপা

বড় মঙ্গল: জ্যৈষ্ঠ মাসের পবিত্র উৎসব ও হনুমানজীর কৃপা
সর্বশেষ আপডেট: 13-05-2025

ভারতবর্ষে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও উৎসবের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সেইসবের মধ্যে একটি অত্যন্ত পবিত্র উৎসব হল "বড় মঙ্গল", যা বিশেষ করে উত্তর ভারত, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে ব্যাপক উৎসাহের সাথে পালিত হয়। এই উৎসবটি হনুমানজীর প্রতি উৎসর্গীকৃত এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতিটি মঙ্গলবার পালিত হয়। এই কারণেই একে ‘বড় মঙ্গল’ বা ‘বুড়ো মঙ্গল’ বলা হয়।

জ্যৈষ্ঠ মাস ও মঙ্গলবারের বিশেষ সংযোগ

জ্যৈষ্ঠ মাস হিন্দু পঞ্জিকার তৃতীয় মাস এবং এটিকে অত্যন্ত তপ ও সাধনার সময় হিসেবে মনে করা হয়। এই মাসে গরম চরমে থাকে, তাই পবিত্র নদীতে স্নান ও ব্রত-উপবাসের বিশেষ গুরুত্ব থাকে। এই মাসের মঙ্গলবার হনুমানজীর কিছু বিশেষ কথা যুক্ত রয়েছে, যা এটিকে অন্যান্য মঙ্গলবার থেকে আলাদা করে।

কেন জ্যৈষ্ঠ মাসেই পালিত হয় বড় মঙ্গল?

বড় মঙ্গল নিয়ে অনেক পৌরাণিক বিশ্বাস প্রচলিত আছে, যার মধ্যে কিছু প্রধান কথা নিম্নরূপ:

  1. ভগবান রাম ও হনুমানজীর প্রথম সাক্ষাত্: রামায়ণ অনুসারে, যখন ভগবান রাম লক্ষ্মণের সাথে মা সীতার সন্ধানে বন-বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, তখন তাঁদের প্রথম সাক্ষাত্ হয়েছিল হনুমানজীর সাথে। এই সাক্ষাত্ জ্যৈষ্ঠ মাসের একটি মঙ্গলবার হয়েছিল। হনুমানজী ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে প্রভু রামের সাহায্য করেছিলেন। সেই দিন থেকেই এই তিথি অত্যন্ত পবিত্র মনে করা হয়।
  2. ভীম ও হনুমানের পুচ্ছের কথা: মহাভারতে বর্ণিত একটি কথার অনুসারে, যখন পাণ্ডবরা বনবাসে ছিলেন, তখন একবার ভীম বনে যাচ্ছিলেন এবং পথে তিনি এক বৃদ্ধ বানর পেয়েছিলেন যার পুচ্ছ পথে পড়েছিল। ভীম তাকে পুচ্ছ সরাতে বলেছিলেন। বানরটি বলেছিল আপনি নিজেই সরিয়ে ফেলুন। ভীম অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি পুচ্ছটিকে একটুও নড়াতে পারেননি। পরে বৃদ্ধ বানরটি তার আসল রূপ প্রকাশ করেছিল—সে নিজেই হনুমানজী ছিলেন। এই ঘটনাও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবার বলে মনে করা হয়, তাই একে ‘বুড়ো মঙ্গল’ও বলা হয়।
  3. লঙ্কা দহনের ঘটনা: রামায়ণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জ্যৈষ্ঠ মাসের সাথে যুক্ত বলে মনে করা হয়। মনে করা হয় যে জ্যৈষ্ঠ মাসের এক মঙ্গলবার রাবণ হনুমানজীর পুচ্ছে আগুন লাগানোর আদেশ দিয়েছিলেন। হনুমানজী সেই আগুন দিয়ে সমগ্র লঙ্কা দাহ করেছিলেন। এই দিন তাঁর বিজয় ও শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
  4. অমরত্বের বর: বিশ্বাস অনুসারে, এই মাসের মঙ্গলবার হনুমানজী চিরঞ্জীবী হওয়ার বর পেয়েছিলেন। তিনি আজও পৃথিবীতে জীবিত আছেন এবং তাঁর ভক্তদের সাহায্য করেন। এই কারণেই জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারকে ‘বড় মঙ্গল’ বলা হয়।

বড় মঙ্গলের ঐতিহ্য

বড় মঙ্গলের দিন হনুমান মন্দিরে বিশেষ পূজা-অর্চনা করা হয়। লখনউ जैसी শহরগুলিতে এই দিনটি উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বিভিন্ন স্থানে হনুমানজীর झांकी সাজানো হয়, ভন্ডার হয় এবং ভক্তদের বিশাল ভিড় জমা হয়। লোকেরা এই দিন উপবাস পালন করে এবং হনুমান চালিসা, সুন্দরকান্ড ইত্যাদির পাঠ করে।

মঙ্গলবারের দিন করা বিশেষ উপায়

বড় মঙ্গলের দিন অথবা যেকোনো মঙ্গলবার যদি আপনি কিছু বিশেষ উপায় করেন তাহলে আপনার জীবনের নেতিবাচকতা দূর হতে পারে এবং সুখ-সমৃদ্ধির আগমন হতে পারে। আসুন জেনে নেই কিছু কার্যকর উপায়:

  • উপায় ১: মাটির পাত্র ও মধু: একটি ছোট মাটির পাত্র নিন এবং তাতে বিশুদ্ধ মধু ভর্তি করুন। তার উপর ঢাকনা লাগিয়ে মঙ্গলবার কোনো হনুমান মন্দিরে রেখে আসুন। এই উপায় আপনার ঘরকে দুষ্ট চোখ ও নেতিবাচকতা থেকে রক্ষা করে এবং সুখ-শান্তি বজায় রাখে।
  • উপায় ২: মাউলি ও সিন্দুরের ব্যবহার: যদি আপনার কাজে বারবার বাধা আসে, তাহলে মঙ্গলবার হনুমানজীর মন্দিরে যান। সেখানে একটি মাউলি (কলাও) ভগবানের চরণে রাখুন এবং চরণ থেকে সিন্দুর নিয়ে কপালে তিলক করুন। এখন মাউলির একটি অংশ আপনার কব্জিতে বাঁধুন এবং বাকিটা সেখানেই রেখে আসুন। এতে কাজে আসা বাধা দূর হয়।
  • উপায় ৩: ছোটোদের ভয় দূর করার জন্য: যদি আপনার বাচ্চা রাতে ভয় পায় অথবা অপরিচিতদের সাথে দেখা করতে সংকোচ করে, তাহলে মঙ্গলবার ভগবান হনুমানকে কেশরিয়া সিন্দুর অর্পণ করুন এবং সেই সিন্দুর বাচ্চার কপালে লাগিয়ে দিন। এই উপায় ভয় দূর করে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
  • উপায় ৪: সূর্যকে জল অর্পণ: স্নানের পর একটা লোটার জলে লাল কনে ফুল দিয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য দিন। এতে ঘরে ইতিবাচক শক্তি আসে এবং আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যদি কনে ফুল না পান তাহলে কিছু চালের দানা ব্যবহার করতে পারেন।
  • উপায় ৫: চাঁপা ফুলের মালা অর্পণ করুন: হনুমানজীর কাছে চাঁপা ফুল অত্যন্ত প্রিয়। মঙ্গলবার চাঁপা ফুলের মালা বানিয়ে তাঁকে অর্পণ করুন এবং ধূপ বাতি জ্বালান। এই উপায় পরিবারে সুখশান্তি বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত উপকারী।

হনুমানজীর কৃপা পাওয়ার অন্যান্য সহজ উপায়

  • মঙ্গলবার লাল বস্ত্র পরুন এবং হনুমান মন্দিরে যান।
  • হনুমান চালিসা অথবা বজরঙ্গ বাণের পাঠ করুন।
  • বুন্দি লড্ডু অথবা চনা-গুড়ের ভোগ দিন।
  • কোনো দরিদ্রকে খাবার অথবা লাল বস্ত্র দান করুন।

বড় মঙ্গল শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি শ্রদ্ধা ও আস্থার উৎসবও বটে। জ্যৈষ্ঠ মাসে এই উৎসব ভক্তদের ভগবান হনুমানের কৃপা পাওয়ার একটি বিশেষ সুযোগ প্রদান করে। এই উৎসব আমাদের অহংকার ত্যাগ করতে, সেবার भावना রাখতে এবং জীবনে ধর্মের পথে চলার অনুপ্রেরণা দেয়। যদি আপনি এই মঙ্গলবারের উপায়গুলি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সাথে করেন, তাহলে আপনার জীবনের অনেক সমস্যা স্বয়ং দূর হতে পারে।

এই বার ২০২৫ সালে প্রথম বড় মঙ্গল ১৩ মে পড়ছে। আসুন, এই শুভ উপলক্ষে হনুমানজীর পূজা-অর্চনা করে তাঁর কাছে আশীর্বাদ লাভ করি এবং আমাদের জীবনকে সুখ-সমৃদ্ধি দিয়ে পরিপূর্ণ করি।

Leave a comment