ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভগৎ সিংয়ের নাম সর্বদা স্মরণীয় থাকবে। তাঁর সংগ্রাম, তাঁর চিন্তাধারা এবং তাঁর আত্মত্যাগ কেবল ভারতকেই নয়, সমগ্র বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভগৎ সিং তাঁর শহীদত্বের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রেম অসীম। আসুন জেনে নেওয়া যাক ভগৎ সিংয়ের জীবন এবং তাঁর অবদান সম্পর্কে।
ভগৎ সিংয়ের প্রাথমিক জীবন
ভগৎ সিংয়ের জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ সালে পঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বঙ্গা গ্রামে, যা বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত। তাঁর জন্ম হয়েছিল এমন এক পরিবারে যারা সম্পূর্ণভাবে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে জড়িত ছিলেন। তাঁর পিতা কিশন সিং এবং কাকা অজিত সিংও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন। ভগৎ সিং যখন জন্মগ্রহণ করেন, সে সময়ও তাঁর পিতা জেলে ছিলেন। এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা ভগৎ সিংয়ের মনে ছোটবেলা থেকেই দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর একটা অনুভূতি জন্ম নিয়েছিল।
ভগৎ সিং তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। ছোটবেলায় তিনি বইয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিলেন। তিনি প্রায়শই বীর ও ক্রান্তিকারীদের কাহিনী পড়তেন এবং তাদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হতেন। বিশেষ করে লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক এবং রামপ্রসাদ বিসমিলের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চিন্তাধারা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভগৎ সিংয়ের মনকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। তিনি সেই স্থানের মাটি পর্যন্ত তাঁর কাছে রেখেছিলেন এবং সেই থেকেই স্থির করেছিলেন যে, দেশকে স্বাধীন না করে তিনি থেমে থাকবেন না। এই অনুভূতিগুলি পরবর্তীকালে তাঁকে একজন মহান ক্রান্তিকারী করে তুলেছিল।
ভগৎ সিংয়ের রাজনৈতিক জীবন
ভগৎ সিং অত্যন্ত কম বয়সেই রাজনীতি ও দেশপ্রেমের পথে পা রেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে দেশ ইংরেজদের দাসত্বে জর্জরিত এবং সাধারণ জনগণ নানা রকম শোষণের শিকার হচ্ছে। প্রথমে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু যখন এই আন্দোলন হঠাৎ করেই প্রত্যাহার করা হয়, তখন তিনি বেশ হতাশ হন। এর পরে তিনি মনে করেন যে, কেবলমাত্র অহিংসার পথে স্বাধীনতা পাওয়া কঠিন।
এই চিন্তাধারা তাঁকে ক্রান্তিকারী সংগঠনের দিকে নিয়ে যায়। তিনি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA) নামক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতে কেবল স্বাধীনতা নয়, একই সাথে একটি ন্যায়সঙ্গত ও সমান সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
ভগৎ সিং স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, তিনি বোমা ও হিংসার ব্যবহার ভয় ছড়ানোর জন্য নয়, বরং জনগণকে সচেতন করার এবং ইংরেজি শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য করেন। তিনি ‘ক্রান্তি’ কে কেবলমাত্র অস্ত্রের সাথে নয়, বরং চিন্তাধারার সাথেও জড়িত করেছিলেন।
অ্যাসেম্বলি বোমা কাণ্ড এবং লাহোরে সন্ডার্সের হত্যা
ভগৎ সিংয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১৯২৯ সালের অ্যাসেম্বলি বোমা কাণ্ড। এই ঘটনায় ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগী বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় বিধানসভা (অ্যাসেম্বলি) তে কাউকে কোনো ক্ষতি না করে বোমা ছুঁড়ে মারেন। তাঁদের উদ্দেশ্য কাউকে হত্যা করা ছিল না, বরং দেখানো ছিল যে, ভারতের যুবকরা আর ইংরেজদের দাসত্ব চুপচাপ সহ্য করবে না। তারা “ইঙ্কিলাব জিন্দাবাদ!” স্লোগান দিয়েছিলেন এবং তারপর সেখানেই বসে গ্রেফতার হন। তাঁদের এই পদক্ষেপ কেবলমাত্র প্রতিবাদ জানানোর জন্য ছিল, যার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার এবং ভারতীয় জনগণ উভয়কেই বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে, এখন পরিবর্তন প্রয়োজন।
এর এক বছর আগে, ১৯২৮ সালে, ভগৎ সিং তাঁর সহযোগীদের সাথে মিলে ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তা জন সন্ডার্সকে হত্যা করেন। এই পদক্ষেপ তিনি তখন নেন কারণ সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় ব্রিটিশ পুলিশের বর্বরতার ফলে লালা লাজপত রায়ের মৃত্যু হয়েছিল। ভগৎ সিং এ অন্যায় সহ্য করতে পারেননি এবং সন্ডার্সকে গুলি করে প্রতিশোধ নেন। এই ঘটনার পর তিনি পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকেন, কিন্তু পরে অ্যাসেম্বলি বোমা কাণ্ডে তিনি নিজেই গ্রেফতার হন। এই দুটি ঘটনা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্রান্তিকারী চিন্তাধারার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ভগৎ সিংয়ের আদালতে সংগ্রাম
অ্যাসেম্বলি বোমা কাণ্ডের পর ভগৎ সিংকে গ্রেফতার করা হলে, তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু তিনি আদালতকে কেবলমাত্র একটি আইনি স্থান হিসাবে মনে করেননি, বরং তিনি তাকে একটি মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করেন, যেখানে তিনি ইংরেজি শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। তিনি আদালতে পুরোপুরি দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে ইংরেজদের নীতির সমালোচনা করেন।
ভগৎ সিং বলেছিলেন যে, তিনি বোমা কাউকে হত্যার জন্য নয়, বরং জনগণকে সচেতন করার জন্য ছুড়ে মেরেছিলেন। তিনি আদালতে ইংরেজি শাসনের অন্যায় নীতি এবং ভারতীয়দের উপর হওয়া অত্যাচারের বিরোধিতা করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে কেবলমাত্র তলোয়ার দিয়ে নয়, বরং চিন্তাধারা দিয়েও লড়াই করা উচিত। ভগৎ সিংয়ের এই সংগ্রাম আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা জরুরি।
ভগৎ সিংয়ের চিন্তাধারা এবং সমাজে তাঁর প্রভাব
ভগৎ সিং কেবলমাত্র একজন ক্রান্তিকারী ছিলেন না, বরং একজন গভীর চিন্তাশীল চিন্তাবিদও ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, কেবল ইংরেজদের দেশ থেকে বের করে দেওয়াই স্বাধীনতা নয়। আসল স্বাধীনতা তখনই হবে যখন দেশের প্রতিটি মানুষ সমতা, সম্মান এবং ন্যায়বিচার পাবে। তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন একটি ভারত, যেখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না, কেউ ধনী-গরিবের পার্থক্যে জীবনযাপন করবে না।
ভগৎ সিং ধর্মের নামে রাজনীতিকেও ভুল বলে মনে করতেন। তিনি চাইতেন ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হোক, যেখানে সকল ধর্মকে সমান স্বাধীনতা ও সম্মান পাবে। তাঁর এই চিন্তাধারা আজকের সময়েও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যখন সমাজে আবারও জাতি ও ধর্মের নামে বিবাদ বেড়ে উঠছে।
তিনি অনেক লেখা ও স্লোগান লিখেছেন যা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল – ‘ইঙ্কিলাব জিন্দাবাদ!’ যার অর্থ পরিবর্তন অমর থাকুক। এই স্লোগানের মাধ্যমে তিনি যুবকদের বলতেন যে, যদি দেশকে পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে চিন্তাধারাও পরিবর্তন করতে হবে।
ভগৎ সিংয়ের অবদান
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভগৎ সিংয়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি কেবলমাত্র একজন ক্রান্তিকারী ছিলেন না, বরং একজন চিন্তাশীল যুবকও ছিলেন, যার চিন্তাধারা তাঁর সময়ের অনেক এগিয়ে ছিল। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য নির্ভয়ে সংগ্রাম করেছেন এবং যুবকদের মধ্যে দেশপ্রেমের আলো জ্বালিয়েছেন।
ভগৎ সিং ‘নওজওয়ান ভারত সভা’র মতো ক্রান্তিকারী সংগঠনের অংশ হয়ে যুবকদের সচেতন করেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, স্বাধীনতা কেবলমাত্র ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, বরং সমাজে সমতা ও ন্যায়বিচার আনাও। তিনি সমাজতন্ত্র ও সমতার কথা বলেছেন, যা আজকের ভারতেও প্রাসঙ্গিক।
তিনি ১৯২৯ সালের ৮ই এপ্রিল সংসদে বোমা ছুঁড়ে ইংরেজি শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে ক্ষতি করেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল – ‘আওয়াজ তোলা যাতে গোঙাও শুনতে পারে।’ এরপর তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তিনি তাঁর প্রাণ দেশের জন্য হাসিমুখে উৎসর্গ করেছিলেন।
ভগৎ সিংয়ের জীবন একটি অনুপ্রেরণা, যা আমাদের বলে যে, যদি হৃদয়ে দেশপ্রেম এবং সঠিক উদ্দেশ্যের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা থাকে, তাহলে কোনও বাধাই তাদের পথ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে না। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, দেশের সেবায় যে কোনও ত্যাগ স্বীকার করা উচিত।