হিন্দু ধর্মে ব্রত-উপবাসের প্রথা অত্যন্ত প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এসব উৎসবের মধ্যে একটি হল বট সাবিত্রী পূর্ণিমা ব্রত, যা সুখী দাম্পত্য জীবন এবং স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে সুহাগিন নারীরা পালন করে। এই ব্রত বিশেষ করে উত্তর ভারতে জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার দিন পালিত হয়। দক্ষিণ ভারতে অমাবস্যার তিথিতে এই উৎসব পালন করা হয়।
বট সাবিত্রী ব্রতের উৎপত্তি মহাভারত কালের একটি পৌরাণিক কথার উপর ভিত্তি করে, যেখানে স্ত্রী সাবিত্রী তাঁর স্বামী সত্যবানের প্রাণ যমরাজের কাছ থেকেও ফিরে পেয়েছিলেন। এই ব্রতের মাধ্যমে নারীর শক্তি, আস্থা এবং সংকল্পকে পূজা করা হয়। ২০২৫ সালে এই পবিত্র ব্রত ১০ জুন (মঙ্গলবার) পালিত হবে।
ব্রত সাবিত্রী পূর্ণিমা ব্রত ২০২৫: তিথি ও শুভ মুহূর্ত
- পূর্ণিমা তিথি আরম্ভ: ১০ জুন ২০২৫ প্রাতঃ ১১:৩৫ টা
- পূর্ণিমা তিথি সমাপ্তি: ১১ জুন ২০২৫ দুপুর ১:১৩ টা
এই অবস্থায় ব্রত ১০ জুনই রাখা হবে, তবে স্নান-দান এবং দান-পুণ্যের কাজ ১১ জুন করা হবে।
ব্রত সাবিত্রী ব্রতের ধর্মীয় গুরুত্ব
এই ব্রতে নারীরা বট (বড়) বৃক্ষের পূজা করে। 'বট' বলতে বড় গাছ এবং 'সাবিত্রী' সেই নারীর প্রতীক যিনি স্বামীর জন্য যমরাজের সাথে যুদ্ধ করে তাঁকে পুনরায় জীবন দান করেছিলেন। এই ব্রত স্বামীর দীর্ঘায়ু, পরিবারের সুখ-শান্তি এবং অখণ্ড সৌভাগ্য লাভের জন্য করা হয়। এই ব্রত এটাও দেখায় যে একজন নারীর শ্রদ্ধা ও তপস্যা যেকোনো পরিস্থিতি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে।
বট সাবিত্রী ব্রত ২০২৫: পূজা বিধি (Puja Vidhi)
- প্রাতঃ ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করুন এবং শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করুন।
- সুহাগিন নারীরা লাল বা হলুদ রঙের বস্ত্র পরুন এবং ষোল শৃঙ্গার করুন।
- ব্রতের সংকল্প করুন এবং পবিত্র অনুভূতি নিয়ে পূজা আরম্ভ করুন।
- বট বৃক্ষের নিচে গিয়ে তার পরিষ্কার করুন এবং মূলে জল অর্পণ করুন।
- কাঁচা দুধ, ফুল, হলুদ, সিন্দুর, রোলী ইত্যাদি দিয়ে বট বৃক্ষের বিধিপূর্ণ পূজা করুন।
- মাউলি (কলাবা) সুতা নিয়ে বট বৃক্ষের সাত বার প্রদক্ষিণ করুন।
- প্রতি প্রদক্ষিণে স্বামীর স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করুন।
- সাবিত্রী ও সত্যবানের কথার পাঠ করুন অথবা ব্রাহ্মণের কাছ থেকে শুনুন।
- শেষে বট বৃক্ষের আরতি করুন এবং ভোগ অর্পণ করুন।
- দিনভর নিরজলা উপবাস রাখুন এবং সন্ধ্যায় ব্রতের পরাণ করুন।
বট সাবিত্রী পূর্ণিমায় কি অর্পণ করবেন ভোগে?
পূজার পর ঈশ্বরকে ভোগ অর্পণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়।
ভোগের উপকরণে থাকতে পারে:
- ঋতুকালীন ফল (কেলা, আম, আপেল ইত্যাদি)
- মিষ্টান্ন (লাড্ডু, খির, পেড়া ইত্যাদি)
- পুড়ি এবং সুজির হালুয়া
- চনার ডাল বা সত্তু
- গুড় এবং নারকেল
ভোগ অর্পণ করার পর ব্রতী নারীরা এটি প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করে। বিশ্বাস করা হয় যে এই ভোগ ঘরে সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য আনে।
ব্রত কথা: সাবিত্রী-সত্যবানের অমর প্রেমকাহিনী
রাজা অশ্বপতির কন্যা সাবিত্রী অত্যন্ত সুন্দরী, গুণবতী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। বিবাহযোগ্য হওয়ার পর রাজা তাঁকে নিজেই যোগ্য বর খুঁজে পেতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বনে বাস করা এক তপস্বী দম্পতির পুত্র সত্যবানকে নিজের স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সত্যবান ধর্মপরায়ণ, সত্যব্রতী এবং সুন্দর যুবক ছিলেন, কিন্তু তাঁর এক বছরের মধ্যে মৃত্যুর অভিশাপ ছিল।
সাবিত্রী এটা জানার পরেও সত্যবানের সাথে বিবাহ করেছিলেন এবং দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন যে তিনি অবশ্যই তাঁর স্বামীর রক্ষা করবেন। বিবাহের পর তিনি শ্বশুরবাড়িতে থেকে সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। এক বছর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সাবিত্রী কঠোর তপ ও উপবাস শুরু করেন।
একদিন সত্যবান বনে কাঠ কাটতে গেলে সাবিত্রীও সাথে গেলেন। সেখানেই সত্যবানের মৃত্যুর সময় এলো এবং যমরাজ তার আত্মা নিতে এলেন। সাবিত্রী যমরাজের পিছু নিলেন। যমরাজ বারবার সাবিত্রীকে থামালেন এবং তাঁকে ফিরে যেতে বললেন, কিন্তু তার নিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তা এবং বাক্যে প্রভাবিত হয়ে যমরাজ তাঁকে তিনটি বর দিলেন (সত্যবানের জীবন ছাড়া):
- তাঁর শ্বশুরের চোখ ও রাজ্য পুনঃপ্রাপ্তি।
- তাঁর পিতার একশো পুত্র হবে।
- নিজেও একশো পুত্রের মা হওয়ার বর।
এটা শুনে যমরাজ অবাক হয়ে গেলেন কারণ একশো পুত্রের মা তখনই হতে পারতেন যদি সত্যবান জীবিত থাকতেন। যমরাজ তাঁর পতিব্রতা শক্তি এবং আত্মসমর্পণে এতটাই প্রভাবিত হলেন যে তিনি সত্যবানের জীবন তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন।
বট সাবিত্রী ব্রতের মন্ত্র (Puja Mantra)
বৃক্ষ পূজনের প্রধান মন্ত্র
বট সিঞ্চামি তে মূলং সলিলৈরমৃতোপমৈঃ ।
যথা শাখাপ্রশাখাভির্বৃদ্ধোऽসি ত্বং মহীতলে॥
তথা পুত্রৈশ্চ পৌত্রৈশ্চ সম্পন্নং কুরু মাম সদা ॥
প্রার্থনা মন্ত্র
অবৈধব্যং চ সৌভাগ্যং দেহি ত্বং মম সুব্রতে।
পুত্রান্ পৌত্রাংশ্চ সৌখ্যং চ গৃহাণার্ঘ্যং নমোऽস্তু তে॥
মহিলাদের জন্য বিশেষ পরামর্শ
- ব্রতের দিন সম্পূর্ণ নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা নিয়ে উপবাস করুন।
- দিনভর সংযম ও সাৎবিকতা পালন করুন।
- রাগ, ঈর্ষা এবং নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকুন।
- এই দিন তামসিক খাবার এবং বস্তু থেকে বিরত থাকুন।
- সন্ধ্যায় ঘরে প্রদীপ জ্বালান এবং ব্রত কথার পাঠ করুন।
ব্রতের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
বট সাবিত্রী ব্রত কেবল ধর্মীয় প্রথা নয়, বরং এটি একজন নারীর শ্রদ্ধা, আত্মবল এবং নিষ্ঠার প্রতীক। এই ব্রত কেবল স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে না, বরং একজন নারীর আত্মবিশ্বাস, প্রেম এবং আত্মসমর্পণেরও সাক্ষী হয়।
বট সাবিত্রী পূর্ণিমা ব্রত ২০২৫ নারীশক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীক উৎসব। এই ব্রত আমাদের এটাও শেখায় যে প্রেম ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। আগামী ১০ জুন ব্রতী নারীরা এই পবিত্র উৎসবটি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও নিয়ম নীতির সাথে পালন করুন, যাতে পরিবারে সুখ-শান্তি ও সৌভাগ্য বজায় থাকে।