২০২৫ সালের গুপ্ত নবরাত্রি: তিথি, গুরুত্ব ও সাধনা পদ্ধতি

২০২৫ সালের গুপ্ত নবরাত্রি: তিথি, গুরুত্ব ও সাধনা পদ্ধতি
সর্বশেষ আপডেট: 13-06-2025

প্রতি বছরের মতো ২০২৫ সালেও গুপ্ত নবরাত্রির পর্ব বিশেষ তান্ত্রিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব নিয়ে পালিত হবে। এবার এই পর্ব জুন মাসের শেষ সপ্তাহে আসছে। আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদা তিথি থেকে আরম্ভ হওয়া এই নবরাত্রিকে গুপ্ত নবরাত্রি বলা হয়, যাতে মা দুর্গার দশ মহাবিদ্যার গুপ্তভাবে সাধনা করা হয়। এই পর্ব তন্ত্র, সাধনা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

গুপ্ত নবরাত্রির আরম্ভ: তিথি ও গুরুত্ব

হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, আষাঢ় শুক্ল প্রতিপদা তিথি ২৬ জুন ২০২৫ (বুধবার) এবং সেদিন থেকেই গুপ্ত নবরাত্রির সূচনা হবে। এই নবরাত্রি তাদের জন্য বিশেষ যারা তন্ত্র সাধনা, মন্ত্রসিদ্ধি বা আত্মকল্যাণের দিকে কাজ করে চলেছেন। যেখানে শারদীয় ও চৈত্র নবরাত্রি সর্বজনীনভাবে পালিত হয়, সেখানে গুপ্ত নবরাত্রি বেশিরভাগ একান্তে সাধনা করার জন্য।

ঘটস্থাপনা মুহূর্ত ২০২৫

গুপ্ত নবরাত্রির শুরু ঘটস্থাপনা দিয়ে হয়, যা দেবীর আহ্বানের প্রতীক বলে মনে করা হয়। ২০২৫ সালে ঘটস্থাপনার জন্য প্রাতঃ ৫:২৬ থেকে ৬:৫৮ পর্যন্ত সময় শুভ বলে মনে করা হয়। এটি প্রতিপদা তিথির সূর্যোদয়ের পর প্রথম প্রহর যা বিশেষভাবে ঘটস্থাপনার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করা হয়। যদি কোনও কারণে এই সময় ঘটস্থাপনা সম্ভব না হয়, তবে ভক্তরা অভিজিত মুহূর্তেও ঘটস্থাপনা করতে পারেন। অভিজিত মুহূর্ত সেদিন দুপুর ১১:৫৬ থেকে ১২:৫৩ পর্যন্ত থাকবে।

গুপ্ত নবরাত্রি: দশ মহাবিদ্যার সাধনার সুযোগ

গুপ্ত নবরাত্রির সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ হল মা দুর্গার দশ মহাবিদ্যার সাধনা। এই দশ মহাবিদ্যা হল:

  1. কালী – অন্ধকার ও মৃত্যুর বিনাশকারী শক্তি
  2. তারা দেবী – সংকট থেকে তারণকারী, মায়া থেকে মুক্তিদাত্রী
  3. ত্রিপুর সুন্দরী – সৌন্দর্য, প্রেম ও আধ্যাত্মিক উচ্চতার দেবী
  4. ভুবনেশ্বরী – সৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী শক্তি
  5. ছিন্নমস্তা – আত্মবলিদান ও জাগ্রতীর প্রতীক
  6. ত্রিপুর ভৈরবী – কর্ম ও তপস্যার দেবী
  7. ধূমাভতি – বিধবা রূপে অদৃশ্য শক্তির রূপ
  8. বাগলামুখী – শত্রুদের স্তব্ধ করার শক্তি
  9. মাঙ্গী – বিদ্যা, সঙ্গীত ও বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী
  10. কমলা দেবী – ধন, বৈভব ও সমৃদ্ধির দেবী

এই দেবীদের সাধনা বিশেষ পদ্ধতিতে করা হয় এবং সাধককে সাধনার সময় পূর্ণ সাত্বিকতা, মৌন এবং একান্তের পালন করতে হয়। এই সাধনা মন, বাক্য এবং শরীরের পূর্ণ শুদ্ধতার দাবি করে।

গুপ্ত নবরাত্রিতে সাধনা ও পূজাবিধি

  • স্নান ও শুদ্ধি: নিত্য প্রাতঃ স্নান করে পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করুন। পূজা স্থান গঙ্গাজল দিয়ে শুদ্ধ করুন।
  • ঘটস্থাপনা: মাটির পাত্রে যব বুনুন এবং তার উপর কলস স্থাপন করুন। কলসে গঙ্গাজল পূর্ণ করুন, আমপাতা লাগান এবং নারকেল রাখুন।
  • দেবীর আহ্বান: দীপ জ্বালিয়ে দেবীকে আমন্ত্রণ করুন। "ॐ ऐं ह्रीं क्लीं चामुण्डायै विच्चे" মন্ত্র দিয়ে আরাধনা করুন।
  • দুর্গা সপ্তশতী পাঠ: নিত্য দুর্গা সপ্তশতীর অধ্যায়গুলির পাঠ করুন অথবা অন্তত কবচ, অর্গলা ও কীলকের পাঠ করুন।
  • চালীসা ও আরতি: শ্রী দুর্গা চালীসা, লক্ষ্মী চালীসা এবং মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্রের পাঠ করুন।
  • বিশেষ সাধনা: তন্ত্র সাধক বিশেষ করে দশ মহাবিদ্যার সাধনা করুন। এর জন্য গুরুর নির্দেশনায় গোপনীয় পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়।

গুপ্ত নবরাত্রিতে করা যোগ্য শুভ কাজ

  • দান-পুণ্য: অন্ন, বস্ত্র, জল এবং দক্ষিণা দান করুন।
  • ধ্যান ও যোগ: একান্তে বসে ধ্যান, প্রাণায়াম এবং মন্ত্রজাপ করুন।
  • মৌন ব্রত: পুরো নয় দিন মৌন ব্রত রাখা তান্ত্রিক সাধনায় বিশেষ ফলদায়ক বলে মনে করা হয়।
  • সাত্বিক আহার: কেবলমাত্র ফল, দুধ, অথবা হালকা সাত্বিক খাবার গ্রহণ করুন। রসুন, পেঁয়াজ, মাংসাহার ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন।

তান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুপ্ত নবরাত্রির গুরুত্ব

গুপ্ত নবরাত্রিকে তন্ত্র সাধকদের জন্য বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী সময় বলে মনে করা হয়। এটি এমন সময় যখন মহাজাগতিক শক্তি সাধকের সাধনায় সহায়ক হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে গুপ্ত নবরাত্রিতে করা সাধনা সাধারণ নবরাত্রির তুলনায় অনেক গুণ বেশি ফল দেয়। কালী তন্ত্র, শ্রীবিদ্যা সাধনা, বাগলামুখী স্তম্ভন তন্ত্র ইত্যাদি অনেক রহস্যময় সাধনা পথের সিদ্ধির জন্য এই সময়ই শ্রেষ্ঠ। তবে এই পদ্ধতিগুলি গুরুর ছাড়া করা উচিত নয়।

গুপ্ত নবরাত্রি কেবলমাত্র পূজার পর্ব নয়, এটি আত্মবোধ, সাধনা এবং ব্রহ্মচেতনা নিয়ে যুক্ত হওয়ার একটি অলৌকিক সুযোগ। এটি তাদের সাধকদের পর্ব যারা ভৌতিক জীবন থেকে এগিয়ে গিয়ে আধ্যাত্মের দিকে পদক্ষেপ নেয়। ২০২৫ সালের গুপ্ত নবরাত্রি ২৬ জুন থেকে শুরু হচ্ছে – সুতরাং ভক্তরা এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করুন এবং এই পবিত্র সাধনা পর্বটি সংকল্প, নিয়ম এবং শ্রদ্ধা নিয়ে সম্পন্ন করুন।

Leave a comment