পাহালগাম হামলার প্রতিশোধ: ভারতের কঠোর কূটনৈতিক পদক্ষেপ

🎧 Listen in Audio
0:00

জম্মু-কাশ্মীরের পাহালগামে সংঘটিত সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ভারত তীব্র কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা শুরু করেছে। বুধবার রাতে দিল্লিতে পাকিস্তানের শীর্ষ কূটনীতিক সাদ আহমদ বরাইচকে তলব করা হয় এবং ভারতের তীব্র আপত্তির বিষয়টি তাঁকে অবগত করা হয়।

নয়াদিল্লি: জম্মু-কাশ্মীরের পাহালগামে মঙ্গলবার সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬ জন নিরপরাধ পর্যটক নিহত এবং অনেকে আহত হওয়ার পর ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এই হামলার দায়িত্ব যদিও কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গ্রহণ করেছে, তবুও ভারত সরকার এটিকে পাকিস্তান প্রায়োজিত সন্ত্রাসবাদের সরাসরি কার্যকলাপ বলে মনে করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অধ্যক্ষতায় বুধবার কেবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস)-এর এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রায় দুই ঘন্টা স্থায়ী হয়। এই বৈঠকে দেশের শীর্ষ রক্ষা এবং বিদেশ নীতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যার প্রভাব সরাসরি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর পড়বে।

১. ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ নোটের সাথে পাকিস্তানকে কঠোর সতর্কতা

ভারত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর উপদেষ্টাদের ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছে। এই নোটটি মধ্যরাতে দিল্লিতে পাকিস্তানের শীর্ষ কূটনীতিক সাদ আহমদ বরাইচকে হস্তান্তর করা হয়। ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এখন সেই দেশে অবাঞ্ছিত এবং তাকে অবিলম্বে দেশ ত্যাগ করতে হবে।

এইসাথে ভারত ইসলামাবাদে অবস্থিত নিজের হাইকমিশন থেকে সামরিক উপদেষ্টাদের ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সরাসরি অর্থ হলো ভারত-পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে এসেছে।

২. সিন্ধু জল চুক্তির অস্থায়ী স্থগিতাদেশ: জলই এখন অস্ত্র

ভারত ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তিকে অবিলম্বে অস্থায়ীভাবে স্থগিত করেছে। এই চুক্তি বিশ্বের অন্যতম অনুকরণীয় জল চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যেখানে ভারত সিন্ধু, ঝেলুম এবং চিনাবের মতো নদীর জলের বেশিরভাগ অংশ পাকিস্তানকে দিয়েছে। এখন ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে যতক্ষণ না পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন বন্ধ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে এক ফোঁটা জলও পাবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তানের সেচ এবং পানীয় জলের ব্যবস্থার উপর গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে।

৩. আটারী চেক পোস্ট বন্ধ: এখন আর সড়কপথে কোনও প্রবেশ নেই

ভারত আটারীতে অবস্থিত ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্টটি অবিলম্বে বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এর অর্থ হলো এখন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সড়কপথে কোনও যাতায়াত হবে না। তবে যাদের কাছে বৈধ কাগজপত্র আছে এবং যারা ইতিমধ্যেই এই পথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে, তাদের ১ মে ২০২৫ পর্যন্ত একই পথ দিয়ে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

৪. সার্ক ভিসা ছাড় প্রকল্প বাতিল, সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিককে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ভারত ত্যাগ করার নির্দেশ

ভারত সরকার পাকিস্তানকে প্রদত্ত সার্ক ভিসা ছাড় প্রকল্প (এসভিইএস)-এর অধীনে প্রদত্ত ভ্রমণ ছাড় বাতিল করে দিয়েছে। এসভিইএস ভিসায় ভারতে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিককে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দেশ ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে পাকিস্তানের নাগরিকদের এই প্রকল্পের অধীনে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।

৫. হাইকমিশনে কর্মী সংখ্যা কমিয়ে ৩০ করা হয়েছে

নয়াদিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনে এখন কর্মীদের সর্বোচ্চ সংখ্যা ৩০ করা হয়েছে, যা বর্তমানে ৫৫। এই সিদ্ধান্ত ১ মে ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। এই সঙ্গে এটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যে ভারত এখন পাকিস্তানের সাথে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক যোগাযোগই বজায় রাখবে।

ভারতের বার্তা স্পষ্ট: সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করা হবে না

সিসিএস বৈঠকের পর বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রি সংবাদমাধ্যমকে সম্বোধন করে বলেন, হামলার দোষীদের যেকোনো মূল্যে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের রক্ষাকারীদেরও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্মোচন করা হবে। ভারত এখন শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেবে না, বরং কৌশলগতভাবে পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরও বলেন, ভারত জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে।

পাকিস্তানে তীব্র আতঙ্ক, শাহবাজ সরকারের জরুরি বৈঠক

ভারতের আক্রমণাত্মক কূটনীতি এবং সিদ্ধান্তের ফলে পাকিস্তান সরকারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির জরুরি বৈঠক ডেকেছেন, যেখানে সেনাবাহিনীর তিনটি অঙ্গের প্রধান, গোয়েন্দা প্রধান এবং জ্যেষ্ঠ কেবিনেট মন্ত্রীরা উপস্থিত থাকবেন। সূত্র মতে, পাকিস্তান এখন ভারতের পদক্ষেপ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির চেষ্টা করবে, তবে ভারতের দৃঢ় প্রমাণ এবং বিশ্বজনমতের কারণে তার এই প্রচেষ্টা দুর্বল বলে মনে করা হচ্ছে।

পাহালগামে নিহত ২৬ পর্যটকের মৃতদেহ তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গোটা দেশে শোক ও ক্রোধের পরিবেশ বিরাজ করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘JusticeForPahalgam’ এবং ‘IndiaStrikesBack’ হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে। দেশজুড়ে পাকিস্তান বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে এবং মানুষ সরকারের কাছে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।

Leave a comment