প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত
সর্বশেষ আপডেট: 27-12-2024

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং ৯২ বছর বয়সে মারা গেছেন। অর্থনীতিতে তাঁর দক্ষতার মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে নতুন দিশা দিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ভারতকে বিশ্ব মঞ্চে শক্তিশালী করেছিলেন।

Manmohan Singh Passed away: ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ মনমোহন সিং ৯২ বছর বয়সে দিল্লির অল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (AIIMS)-এ মারা গেছেন। একজন শক্তিশালী নেতা, যিনি ভারতের অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে নতুন দিশা দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। ডঃ সিং-এর জীবন ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি তাঁর কর্মজীবনে অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ভারতকে বিশ্ব মঞ্চে একটি শক্তিশালী ও সম্মানিত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

অর্থনীতিবিদ থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সফর

ডঃ মনমোহন সিং-এর জীবন ছিল একটি অনুপ্রেরণামূলক যাত্রা। তিনি একটি ছোট পাঞ্জাবি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। তাঁর অর্থনৈতিক জ্ঞান এবং বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে একজন অনন্য নেতা করে তুলেছিল। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম শিখ প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর কার্যকাল ছিল ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কার্যকালে তিনি দেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব সংকট সত্ত্বেও দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন।

শিক্ষাজীবন এবং প্রারম্ভিক কর্মজীবন

ডঃ মনমোহন সিং ১৯৩২ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের গাহে (বর্তমানে পাকিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার ভারতে এসে বসতি স্থাপন করে। দেশভাগের পর তাঁরা প্রথমে হলद्वानी, উত্তরাখণ্ড এবং পরে অমৃতসরে বসবাস করেন। তিনি অমৃতসরের হিন্দু কলেজ থেকে তাঁর প্রারম্ভিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর, তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেন্ট জনস কলেজ, কেমব্রিজের সদস্য ছিলেন।

পেশাদার কর্মজীবন ও সরকারি পরিষেবা

ডঃ মনমোহন সিং ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনে (UNCTAD) কাজ করেন। পরে তিনি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর (১৯৮২-১৯৮৫), পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান (১৯৮৫-১৯৮৭) এবং কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের প্রধান পদে কাজ করেন। তিনি ১৯৯০ সালে চন্দ্রশেখর সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।

১৯৯১ সালে ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ

১৯৯১ সালে, যখন ভারত একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও ডঃ মনমোহন সিংকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই সময় তিনি ভারতে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করেন। তিনি অর্থনীতিকে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়নের দিকে নিয়ে যান, যা ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্ব মঞ্চে একটি নতুন স্থান এনে দেয়। এই সংস্কারগুলি ভারতকে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে এবং ভারতীয় শিল্পগুলিকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তোলে।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যকাল

২০০৪ সালে, কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বে সম্মিলিত প্রগতিশীল জোট (UPA) সরকার গঠিত হয় এবং সোনিয়া গান্ধী অপ্রত্যাশিতভাবে ডঃ মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী পদ অর্পণ করেন। তাঁর প্রথম মন্ত্রক জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, স্বতন্ত্র পরিচয় কর্তৃপক্ষ, গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প এবং তথ্য অধিকার আইন-এর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন ও প্রকল্প চালু করে।

২০০৮ সালে, তাঁর সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি ঐতিহাসিক অসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ছিল ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এরপর, তিনি ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেন। তা সত্ত্বেও, তাঁর কার্যকালে বেশ কিছু বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছিল, যেমন ২জি স্পেকট্রাম বরাদ্দকরণ এবং কয়লা ব্লকগুলির বরাদ্দকরণে দুর্নীতির অভিযোগ, যা তাঁর সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

বিরোধিতা ও বিতর্ক সত্ত্বেও স্থিতিশীল নেতৃত্ব

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০০৯ সালে ইউপিএ সরকার আরও বেশি জনসমর্থন নিয়ে পুনরায় নির্বাচিত হয়। যদিও, তাঁর সরকারকে ২০১০ সালের কমনওয়েলথ গেমসের আয়োজন, ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি এবং কয়লা ব্লক বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি সর্বদা স্থিতিশীলতা ও নিষ্ঠার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

ব্যক্তিগত জীবন এবং পরিবার

ডঃ মনমোহন সিং ১৯৫৮ সালে গুরশরণ কৌরকে বিয়ে করেন। তাঁদের তিন মেয়ে রয়েছে: উপিন্দর সিং, দমন সিং এবং অমৃত সিং। তাঁর পরিবার ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজে একটি সম্মানজনক স্থান অধিকার করে। ডঃ মনমোহন সিং কখনও লোকসভার সদস্য ছিলেন না, কিন্তু তিনি রাজ্যসভায় আসাম ও রাজস্থানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

মনমোহন সিং-এর অবদান

ডঃ মনমোহন সিং-এর জীবন শুধুমাত্র একজন মহান অর্থনীতিবিদ ও নেতা হিসেবেই নয়, বরং একজন এমন ব্যক্তি হিসেবেও স্মরণ করা হবে যিনি ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক পরিবর্তন করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিশ্ব মঞ্চে ভারতকে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতির জগৎ এক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হারিয়েছে, কিন্তু তাঁর অবদান সর্বদা দেশে জীবন্ত থাকবে।

```

Leave a comment